শনিবার রাতে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে অমানুষিক নির্যাতনে মৃত্যু হয় রায়হান উদ্দিন নামের এক যুবকের। তার হাতের নখ তুলে নেয়ার চিহ্নসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। পুলিশের নির্যাতনে যুবক চিৎকার করতে থাকেন। সেই চিৎকার শুনেছেন আশপাশের মানুষও।
ওই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বসবাস বন্দরবাজার ফাঁড়ি লাগোয়া কুদরত উল্লাহ মার্কেটের রেস্ট হাউসে। তিনি জানান, রাত ২টার দিকে এক যুবক হাউমাউ করে কাঁদছিলো। বলছিলো- ‘আমি চোর, ডাকাত না। আমাকে মেরো না।’ বার বারই ভেসে আসছিলো কান্নার আওয়াজ। ভোররাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তারা কান্নার আওয়াজ শোনেন। এরপর নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীর নাম হাসান খান। ১০২ নম্বর কক্ষেই থাকেন তিনি। তার কক্ষের দেওয়াল ঘেঁষা যে টিনশেডটির বাসা রয়েছে সেটিই বন্দরবাজার ফাঁড়ি। এই ফাঁড়ির ৩ নম্বর কক্ষে রেখে নির্যাতন করা হয় নিহত রায়হান উদ্দিনকে। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে ওই রাতের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেন হাসান খান।
জানান- এক আত্মীয়কে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে তিনি রাত পৌনে দু’টার দিকে রুমে ফিরেন। ঘরের দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকেই শুনেন চিৎকারের শব্দ। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে আসতে সেই আওয়াজ। আর্তনাদ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হন। তার সঙ্গে ১০০ নম্বর কক্ষে বসবাসকারী ব্যক্তিও বের হন। তারা শোনেন ফাঁড়ি থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। এক যুবক হাঁউমাউ করে কাঁদছে আর চিৎকার করছে। বলছে- ‘আমি চোর না, ডাকাত না। আমাকে মেরো না।’ একটু পর কান্নার আওয়াজ কমে যায়।
তিনিও ঘরে ঢুকে যান। এর কিছু সময় পর আবারো শোনেন কান্নার আওয়াজ। একই ভাবে কান্না করছিলো ওই যুবকটি। ভোররাত পর্যন্ত এভাবে ক্ষণে-ক্ষণে তারা কান্নার আওয়াজ শোনেন। তবে- ভোররাতের পর আর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়নি বলে জানান হাসান খান।
কুদরত উল্লাহ মসজিদে নামাজ পড়ে এক বৃদ্ধকে দেখতে পান। তিনি ফাঁড়িতে এসে তার ছেলের খোঁজ করছেন। সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়ি। সবার কাছে অজানা এক আতঙ্কের নাম। এই ফাঁড়ির দায়িত্বে এসে এসআই আকবর ভূঁইয়া গড়ে তুলেছেন টর্চার সেল। পথ থেকে লোকজনকে ধরে আনেন ফাঁড়িতে। আর ফাঁড়িতেই তিনি টাকার জন্য নির্যাতন করেন। হাসান খান জানিয়েছেন- প্রায় দুই মাস আগে তিনি একইভাবে আরেক যুবকের কান্নার আওয়াজ শুনেছিলেন।
আরও পড়ুন : সিলেটে নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু: ৪ পুলিশ বরখাস্ত
এর আগে এক কিশোরেরও কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। এভাবে প্রায় সময়ই ফাঁড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পান বলে জানান তিনি। এদিকে- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে জীবিত নিয়ে আসার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন- ঘটনার দিন রাতে পুলিশ সদস্যরা রায়হানউদ্দিনকে নিয়ে ফাঁড়িতে ঢুকেন।
ভোরে তাকে ফাঁড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার সময় রায়হানের দুই হাত ছিলো দুইজনের কাঁধে। পা খুঁড়িয়ে চলছিল। তারা তদন্তকালে সিসিটিভি’র ফুটেজ পর্যালোচনা করে এ তথ্য পেয়েছেন। ওই রাতে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর সাদা পোশাকেও ফাঁড়িতে ছিলেন। তাকেও দেখা গেছে ওই সময়। ফলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়ে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল মারা যাওয়া যুবক রায়হান উদ্দিনকে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়- বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেক এলাহীর নেতৃত্বে আটক করা হয়েছিল রায়হান উদ্দিনকে। তদন্ত কমিটির কাছে এ তথ্য জানিয়েছে ওই দিনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। এরপর ভোররাত ৪ টার দিকে এসআই আকবরের নির্দেশে কনস্টেবল তৌহিদের ফোন থেকে ফোন করা হয় রায়হানের মা সালমা বেগমকে। আর ওই ফোনে শেষ কথা বলেন রায়হান।
ফোন করে তার সৎ বাবা মো. হাবিবউল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার কথা বলা হয়েছে। পুলিশ জানায়- ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত পাওয়ার পর ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরের পাশাপাশি কনস্টেবল হারুনুর রশীদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তদন্তে তারা দোষী প্রমাণিত হলে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। এর পাশাপাশি ফাঁড়ির এএসআই আশেক এলাহী ও কুতুব আলী, কনস্টেবল সজিবকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্তকালে পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা কাস্টঘরে ছিনতাইয়ের কথা বললেও ছিনতাইকারীর কবলে পড়া ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ঊর্ধ্বতনদের কাছে অভিযুক্তরা জানিয়েছে- ওই ব্যক্তি অভিযোগ দিয়ে চলে গেছে। তারাও ওই ব্যক্তিকে চিনেন না। এদিকে- ফজরের নামাজের পর ফাঁড়িতে গিয়েছিলেন নিহত রায়হানের পিতা। ওই সময় আকবরকে তিনি সাদা পোশাকে ফাঁড়িতে দেখেছেন। আকবরের সামনেই এক কনস্টেবল তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেছিল।