নিজস্ব প্রতিবেদক :
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ২০২৩ সাল থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসছে সরকার। এর জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। উদ্যোগটি গ্রহণের দুই বছর হতে চললেও ভুক্তভোগীদের সিংহভাগই রয়ে গেছেন ক্ষতিপূরণের বাইরে। অথচ তহবিলে অলস পড়ে আছে ২৫৫ কোটির বেশি টাকা।
বিআরটিএর সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন এবং ক্ষতিপূরণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের ৯০ শতাংশের বেশি পরিবারই কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিত্র আরো করুণ, ৯৮ শতাংশের বেশি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এমন প্রেক্ষাপটেই আজ পালিত হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেম্বারেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিকটিমস’। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতি বছর নভেম্বরের তৃতীয় রোববারে এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে আজ রাজধানীর বনানীস্থ প্রধান কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে বিআরটিএ।
সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কারো মৃত্যু হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এককালীন অন্যূন ৫ লাখ টাকা। দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্যূন ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ অন্যূন ৩ লাখ টাকা দেয়ার নিয়ম। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে অন্যূন ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ কার্যক্রম সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণায় ঘাটতি, দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনের বাধ্যকতা এবং কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ভিকটিম কিংবা তার পরিবার তা পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রত্যেক মোটরযান মালিকের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলে তহবিলটি গঠন করা হয়েছে। এর জন্য বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের মতো যানবাহন থেকে বার্ষিক দেড় হাজার; মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপ থেকে ৭৫০; কার, জিপ ও মাইক্রোবাস থেকে ৫০০; থ্রি-হুইলার ও অন্যান্য যানবাহন থেকে বার্ষিক ৩০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলের জন্য এককালীন ১ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর বাইরে সরকারের অনুদান, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন বেসরকারি খাত থেকেও তহবিলের জন্য অনুদানের সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৬৬৮ জন হতাহতের বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় নিহত ১ হাজার ৪০৫ জনের পরিবারকে দেয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ।
বিআরটিএর মাসিক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময়ে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৪ হাজার ২৪৫ জন। বিপরীতে একই সময়ে সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হলেও ক্ষতিপূরণ হিসেবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন কেবল ২৬৩ জন।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতিপূরণ পাওয়া কার্যক্রম শুরুর দুই বছর হতে চললেও বিষয়টি সম্পর্কে এখনো অবহিত নন দেশের অনেক মানুষ। এজন্য সড়ক দুর্ঘটনা তহবিল সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার ঘাটতিকে দায়ী করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আইন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে হয়। এ সময়সীমার কারণে অনেক মানুষ ক্ষতিপূরণের বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘এটা (ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন) এক মাসের মধ্যে করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এ সময় দাফন/সৎকার বা চিকিৎসার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শোকগ্রস্ত, ট্রমাটাইজ থাকার কারণে অনেকের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণের আবেদন করা সম্ভব হয় না। এমন প্রেক্ষাপটে বিআরটিএকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এখন থেকে তারা নিজে থেকেই দুর্ঘটনায় হতাহতের খোঁজ-খবর করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করবে।’
দেশের পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, মোটরযান নিবন্ধনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলোই ঠিকমতো করতে পারে না। এমন প্রেক্ষাপটে বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ কাজটি কতটা সঠিকভাবে করতে পারবেন এবং এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘বিআরটিএতে জনবল আসলে অনেক বেশি। দেশের যেকোনো সরকারি অফিসে যা জনবল প্রয়োজন, তার থেকে অনেক বেশি আছে। কিন্তু মুশকিল হলো এরা কাজ করে না, অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে।’
পুলিশ, হাসপাতাল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ অংশীজনদের নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার একটি কর্মকৌশল গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনায় হতাহতদের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’
নিজস্ব প্রতিবেদক 





















