ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি :
নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সক্ষমতা যাচাইয়ে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সকাল ১১টায় ময়মনসিংহ নগরীর সার্কিট হাউস মাঠে জেলা ও মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জামায়াত আমির বলেন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিধি না থাকার কারণে জনগণ ভোগান্তিতে রয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা যাচাইয়ে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন। এতে জনগণ বুঝতে পারবে ইসির সদিচ্ছা কতটুকু। তবে বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দিলে জনগণ মেনে নেবে না।
জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটা নির্বাচন কমিশন হয়েছে। তাঁরা বলেছেন তাঁরা নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দেবেন। আমরা তাঁদের একটি অ্যাসিড টেস্ট দেখতে চাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেটা দিয়ে পাঁচ বছর দেশ শাসন হবে, সেই নির্বাচনের আগে জনগণ এখন সাফার করছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিধি না থাকার কারণে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দিন। আমরা দেখি আপনাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা কতটুকু। এটার প্রমাণ আপনারা পেশ করুন।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জামায়াত আমির বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যদি জনগণ সন্তুষ্ট হয়, তাহলে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। এখানে যদি কোনো কিছু ধরা পড়ে তাহলে নির্বাচন কমিশনকে হলুদ নয়, লাল কার্ড দেখাবে।
প্রায় ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন জামায়াতের আমির। তিনি সংসদে সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, সংসদ দুই কক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ। মূল কর্তৃত্ব থাকবে নিম্নকক্ষের হাতে। সেটার নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, আর উচ্চকক্ষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পিআর সিস্টেমে। উচ্চকক্ষ যদি পিআর সিস্টেমে হয়, তাহলে নিম্নকক্ষ নয় কেন? একই দেশে দুই পদ্ধতির প্রয়োজনটা কী। দুনিয়ার ৬২টি দেশ পিআর সিস্টেমে নির্বাচন করে। তাঁরা যদি সুফল যুগ যুগ ধরে ভোগ করে তাহলে এই সুফল থেকে জাতিকে বঞ্চিত করার আমরা কে? সুতরাং এই অধিকার জাতির হাতে তুলে দিতে হবে। যাঁরা মানবেন না তাঁরা হলো, বিচার মানি তালগাছটা আমার। আমরা বলব বিচার মানুন, রায়ে তালগাছ যাঁর তাঁর হাতে যাবে।’
কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার কোনো ধরনের সুপারিশ মানা হবে না উল্লেখ করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা ১৮ কোটি মানুষকে সুবিধা দেওয়ার যত সুপারিশ আছে তা-ই মানব। আপনাদের সবার কাছে আমাদের অনুরোধ, সবাই নিজেকে গড়ুন। ঘরে ঘরে ন্যায় ও সত্যের আওয়াজ পৌঁছে দিন। জনগণকে অসত্য ও অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত করুন। হয়তো বা অপরাধীদের দমন করার জন্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার জন্য আমাদের সবাইকে রাস্তায় নামতে হতে পারে, তার জন্য তৈরি হোন।’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এমন একটি দেশ চাই যেখানে কোনো শোষণ, জুলুম ও মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না; দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবো না এবং সবার অধিকার থাকবে সমান।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মূল কর্তৃত্ব থাকবে নিম্নকক্ষের হাতে। এটি হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, আর উচ্চকক্ষ হবে পিআর পদ্ধতিতে। উচ্চকক্ষ যদি পিআর পদ্ধতিতে হয় তাহলে নিম্নকক্ষ কেন হতে পারবে না? একই দেশে দুই পদ্ধতির প্রয়োজন কী? পৃথিবীর ৬২টি দেশ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করে। ইউরোপের ২৬টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করে। এই সুফল যদি তারা যুগ যুগ ধরে পেয়ে থাকে তাহলে আমরা এ সুবিধা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করার কে। এটা যারা মানবেন না, মনে করতে হবে—তারা হলো বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, নারী অধিকার সংস্কারের নামে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট জমা হয়েছে। সেই রিপোর্টের বেশ কিছু জায়গায় কোরআন ও সুন্নার সম্পূর্ণ খেলাপ কিছু সুপারিশ জমা হয়েছে। কিন্তু যারা এই সুপারিশ পেশ করেছেন, তারা এদেশের সাড়ে ৯ কোটি মায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা যে জায়গায় সমাজকে নিতে চায়, সেটা হতে দেওয়া হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরলেই এটি বাতিলের জন্য আহ্বান জানানো হবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দুনিয়ার সমস্ত পরিবর্তন হয়েছে তরুণদের ওপর ভর করে। জুলাই আগস্টে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে এই তরুণদের মাধ্যমেই। তরুণ যুব সমাজের অনেকেই শহীদ হয়েছে। তোমাদের ন্যায্য দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তরুণরা এই সংগ্রামে বিশ্রাম নিও না। তোমরা হবে আমাদের আগামী দিনের নেতা আর আমরা হবো সহযাত্রী। এই বিজয়ের মাধ্যমে কোনও দল বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় আনার উদ্দেশ্য হবে না।
জামাতে ইসলামীর আমির বলেন, অতীতের যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেই ঘটনাগুলো যদি এখনও ঘটে তাহলে এত জীবন এবং এত রক্ত দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল। আমরা শহীদ পরিবারের কাছে কী জবাব দেব। দোলনের যারা শহীদ হয়েছে তাদের আত্মা আমাদেরকে অভিশাপ দেবে। শহীদ ভাইদের প্রতি সম্মান রেখে বাংলাদেশকে জঞ্জাল মুক্ত, কলুষ মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত ও সন্ত্রাস মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে আরেকবার আমরা জীবন দিতে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে। সেই টাকা দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশ থেকে পালিয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদেরকেও আমাদের দেশে এনে বিচার করতে হবে।
বক্তব্যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গও টানেন জামায়াতের আমির। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে যে কয়জন এই সুপারিশমালা তৈরি করেছেন, তাঁরা এই দেশের সাড়ে ৯ কোটি মায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা সমাজকে যে জায়গায় নিয়ে যেতে চান, সে কথা বলতেও আমার লজ্জা করে। আমরা সেই জায়গায় তাঁদেরকে নিতে দেব না ইনশা আল্লাহ। এ দেশের মানুষের একটি সংস্কৃতি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আঘাত দিলে সমাজের পুরো শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাবে, এটা আমরা মানব না। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করব, আপনি দেশে ফিরে বিলম্ব না করে আগে এই কাজটি বাতিল করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর যদি এমন কোনো কমিশন করতে হয়, তাহলে সব শ্রেণি–পেশা, দল এবং আদর্শের মানুষকে নিতে হবে। সেখানে ঈমানদার মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, যাঁরা কোরআন হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। তারপর দেখা যাবে কী আসে, তারপর আমরা বিবেচনা করব, তার আগে নয়।’
মহানগর জামায়াতের আমির মাওলানা কামরুল আহসান এমরুলের সভাপতিত্বে ও মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ কায়সার এবং জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা মোজাম্মেল হক আকন্দের যৌথ সঞ্চালনায় কর্মী সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন— কেন্দ্রীয় নির্বাহী মিডিয়া ও প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির আসাদুজ্জামান সোহেল, জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলন, কিশোরগঞ্জ জেলা আমির অধ্যাপক রমজান আলী, নেত্রকোনা জেলা আমির অধ্যাপক সাদেক আহমেদ হারিছ, জামালপুর জেলা সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আবদুল আওয়াল, ছাত্রশিবির সাবেক সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আল হেলাল তালুকদার প্রমুখ।