স্পোর্টস ডেস্ক :
এশিয়া কাপে দেখা গেল আরেকটি রোমাঞ্চকর লড়াই, যেটি গড়াল শেষ ওভার পর্যন্ত। ২৬৬ রানের লক্ষ্যে শুরুতে উইকেট হারিয়ে চাপে পড়েছিল ভারত। তবে লম্বা একটা সময় তাদের লড়াইয়ে রেখেছিলেন শুবমান গিল। তাঁর উইকেটের পর অবশ্য ব্যাকফুটে থাকা ভারতকে এগিয়ে নিয়েছিলেন অক্ষর প্যাটেল। শেষের আগের ওভারেও বাংলাদেশের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন তিনি। সেই হুমকি চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের লাগাম পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়েছেন মুস্তাফিজরা। এশিয়া কাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে ভারতকে ৬ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ব্যাটিংয়ে বোলাররা যেমন আজ বাংলাদেশের হয়ে দারুণ করেছেন, বোলিংয়ে নিজেদের কাজটিও করেছেন দারুণভাবে। সাকিবও তাঁর বোলারদের ব্যবহার করেছেন দারুণভাবে। তাসকিন, হাসান মাহমুদরা ছাড়াও বাংলাদেশের এ জয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কথা বোলারদের। আর বাজে একটি এশিয়া কাপের শেষে ভারতকে হারানো বাংলাদেশের জন্য হতে পারে সান্ত্বনার চেয়েও বেশি কিছু।
৪৯তম ওভারের প্রথম বল। মোস্তাফিজকে ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে স্কয়ার লেগে থাকা মিরাজের হাতে ধরা পড়েছেন শার্দূল ঠাকুর। রিপ্লে দেখে কোনো সংশয়ই ছিল না, যদিও অন ফিল্ডের আম্পায়াররা শুরুতে নিশ্চিত ছিলেন না। আর মিরাজ যে সেখানে ছিলেন, সেটিও যেন ভুলে গিয়েছিলেন শার্দূল।
কিন্তু স্ট্রাইক ফিরে পেয়ে তৃতীয় বলে ফুলটস পেয়ে কাভার দিয়ে চার মেরেছেন অক্ষর। চতুর্থ বলে ছিল স্লোয়ার, তাতে আর টাইমিং করতে পারেননি অক্ষর। তানজিমের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন। লং অফ থেকে ছুটে এসে ভালো ক্যাচ নিয়েছেন তানজিম। শেষ ২ বলে রান নিতে পারেননি প্রসিধ কৃষ্ণা।
শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠান অধিনায়ক রোহিত শর্মা। শুরুতেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে টাইগাররা। তবে সাকিব ও তাওহিদ হৃদয়ের ফিফটির সঙ্গে নাসুম আহমেদের ব্যাটে ভর করে ২৬৫ রানের লড়াকু পুঁজি পায় বাংলাদেশ। সাকিব ৮৫ বলে ৮০, হৃসয়, ৮১ বলে ৫৪ ও নাসুম ৪৫ বলে ৪৪ রান করেন।
২৬৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে ভারত। অভিষিক্ত তানজিম সাকিবের হাতে প্রথম ওভারেই বল তুলে দেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বল হাতে সাকিবের শুরুটা হয় ওয়াইড দিয়ে। তবে ছন্দে ফিরতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। ওভারের দ্বিতীয় বৈধ ডেলিভারিতেই উইকেটের দেখা পান সাকিব। রোহিত শর্মা কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে পয়েন্টে ধরা পড়েন আনামুল হক বিজয়ের হাতে। শূন্য রানেই সাজঘরে ফেরেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক।
তিনে নামা তিলককেও বেশিক্ষণ টিকতে দেননি তানজিম সাকিব। অভিষেকের দিনে শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। সাকিবের তৃতীয় বলটি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিলক, সেটি বেরিয়েও যায়। পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করেছিলেন পরের বলেও। কিন্তু বল ভেতরে ঢুকে স্টাম্পে আঘাত করে। ফলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় ৫ রান করা এই ব্যাটারকে। ১৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত।
৪ নম্বরে নামা লোকেশ রাহুলকে সঙ্গী করে শুরু চাপ সামাল দেন ওপেনার শুভমান গিল। ৮৭ বলে ৫৭ রানের জুটি গড়েন তারা। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা এই জুটির দুর্গে আঘাত হানেন শেখ মেহেদী। শামিম হোসেন পাটোয়ারীর হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে সাজঘরে ফেরেন ১৯ রান করা রাহুল। একপ্রান্ত আগলে রেখে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৯ম ফিফটি তুলে নেন গিল।
৫ নম্বরে নামা ইশান কিশানও বেশিদূর এগোতে পারেননি। ৫ রান করা এই ব্যাটারকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। রিভিউ নিলেও আউটের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি ইশান। এরপর ক্রিজে আসেন সুরিয়া কুমার যাদব। তাকে সঙ্গে নিয়ে ৫৫ বলে ৪৫ রানের জুটি গড়েন শুভমান গিল। তবে ভয়ঙ্কর ওঠা সুরিয়া কুমারকে বোল্ড আউট করে জুটি ভাঙেন সাকিব। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের শিকার হওয়ার আগে ৩৪ বলে তিন চারে ২৬ রান করেন সুরিয়া। তার বিদায়ে ৩২.৪ ওভারে ১৩৯ রানে পঞ্চম উইকেট হারায় ভারত।
এরপর ক্রিজে এসে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি বাঁহাতি ব্যাটার রবীন্দ্র জাদেজা। মোস্তাফিজের বলে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে বলের লাইন মিস করেন জাদেজা। বল গিয়ে সোজা আঘাত হানে স্টাম্পে। ১২ বলে ৭ রান করে সপ্তম ব্যাটার হিসেবে সাজঘরে ফেরেন জাদেজা। তবে একপ্রান্ত আগলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫ম সেঞ্চুরি তুলে নেন ভারতীয় দলের তরুণ তারকা ব্যাটার শুভমান গিল। ১১৭ বলে ৬টি চার আর ৪টি ছক্কার সাহায্যে তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগার স্পর্শ করেন গিল।
সেঞ্চুরির পর আরও আগ্রাসী হয়ে খেলতে থাকেন গিল। আক্সার প্যাটেলকে সঙ্গী করে সপ্তম উইকেট ৩৯ রানের জুটি গড়েন গিল। ৪৪তম ওভারে শেখ মেহেদীর করা ৩য় বলে ছক্কা হাঁকান গিল, পরের বল আবারও তুলে মারতে গিয়ে লং অফে দাঁড়িয়ে থাকা তাওহিদ হৃদয়ের হাতে ধরা পড়েন তিনি। আউট হওয়ার আগে ১৩৩ বলে ৮টি চার ও ৫টি ছক্কার সাহায্যে ১২১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন এই ওপেনার।
গিল আউট হলেও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন আক্সার প্যাটেল। ৪৫ তম ওভারে নাসুম আহমেদকে ১টি ছক্কা ও ১টি চার হাঁকান আক্সার। ৪৮তম ওভারেও শেখ মেহেদীকে ১টি ছক্কা ও ১টি চার মারেন এই বাঁহাতি ব্যাটার। তাতে ভারতের জয়ের জন্য শেষ ২ ওভারে দরকার ছিল ১৭ রান। ৪৯তম ওভারের প্রথম বলেই শার্দুল ঠাকুরকে ফেরান মোস্তাফিজ। একই ওভারের ৪র্থ বলে ডেঞ্জারম্যান আক্সারকে ফেরান কাটার মাস্টার। ৩৪ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কার সাহায্যে ৪২ রান করে সাজঘরে ফেরেন আক্সার।
শেষ ওভারে ভারতের জয়ের জন্য দরকার ছিল ১২ রান আর বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১টি উইকেট। বল হাতে আসেন অভিষিক্ত পেসার তানজিম সাকিব। প্রথম বলেই বাউন্সারে শামির হেলমেটে আঘাত, পরের বলে দারুণ এক স্লোয়ারে বোকা বানানো সাকিব ম্যাচ গ্রিপে নিয়ে নেন। তৃতিয় বলটিও ব্যাটে লাগাতে পারেননি শামি। চতুর্থ বল সীমানা ছাড়া করলেও পঞ্চম বলে ২ রান নিতে গিয়ে রান আউট হন শামি। ফলাফল ৬ রানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। টাইগারদের হয়ে সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট পান মোস্তাফিজুর রহমান। ২টি করে উইকেট নেন শেখ মেহেদী এবং তানজিম সাকিব। এছাড়াও ১টি করে উইকেট নেন সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে যথারীতি বাংলাদেশের টপ-অর্ডাররা ব্যর্থ হন। এদিন অবশ্য নতুন উদ্বোধনী জুটি নিয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছিলেন তানজিদ হাসান তামিম, তিনি সুযোগ পান আবার শেষ ম্যাচে এসে; তার সঙ্গী হন লিটন দাস।
তামিম শুরুটা করেছিলেন বেশ ভালো। প্রথম ওভারে মোহাম্মদ শামিকে একটি বাউন্ডারি হাঁকান, পরে শার্দুল ঠাকুরকে দুটি। কিন্তু তৃতীয় ওভারে এসেই প্রথম উইকেট পেয়ে যায় ভারত। শামীর ইনসুইং বুঝতেই পারেননি লিটন, তিনি হয়ে যান বোল্ড। দুই বল খেলে শূন্য রানে সাজঘরে ফেরেন লিটন। শুরুতে ভালো কিছুর আশা দেখানো তানজিদ তামিম আউট হন ঠিক পরের ওভারে।
১২ বলে ১৩ রান করে শার্দুলের স্লোয়ার বাউন্সার পুল করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান তিনি। ছয় মাসে নানা নাটকীয়তার পর সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয়ও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। মুখোমুখি হওয়া প্রথম ৮ বলই ডট দেন তিনি। এরপর একটি বাউন্ডারি হাঁকান। মাঝে একটি ডট দিয়ে পরে শামীকে পুল করতে যান; কিন্তু বলে যথেষ্ট বাউন্স ছিল না। বল ব্যাটে লেগে উপরে উঠলে ক্যাচ নেন উইকেটরক্ষক লোকেশ রাহুলই।
দ্রুত তিন উইকেট হারানোর পর পাঁচে পাঠানো হয় মেহেদী হাসান মিরাজকে। কিন্তু কখনোই তাকে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য লাগছিল না, মাঝে তিলক ভার্মা ক্যাচও ছাড়েন। তারপর ২৮ বলে ১৩ রান করে অক্ষর প্যাটেলের বলে স্লিপে ক্যাচ দেন মিরাজ। ৫৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলা দলের হাল ধরেন তাওহীদ হৃদয় ও সাকিব আল হাসান।
সাকিব এতক্ষণ একাই লড়াই করছিলেন, পরে সঙ্গী হিসেবে পান হৃদয়কে। শুরুতে কিছুটা ধীরস্থির খেললেও পরে হাত খোলেন তাওহীদ। সাকিব হাফ সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে এগোচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। দীর্ঘদিন ধরে তিন অঙ্কের দেখা না পাওয়া এই ব্যাটার স্বাচ্ছন্দ্যেই চার-ছক্কা হাঁকাচ্ছিলেন।
কিন্তু পানি পানের বিরতির পরই মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন সাকিব। শার্দুল ঠাকুরের ভেতরে ঢোকা বল ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় স্টাম্পে। ৬ চার ও ৩ ছক্কায় ৮৫ বলে ৮০ রান করে আউট হন সাকিব। হৃদয়ের সঙ্গে তার ১০১ রানের ম্যাচে ফেরানো জুটিটিও ভেঙে যায়। এরপর টানা দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন তাওহীদ হৃদয়।
এই ব্যাটারকে ভালো সঙ্গ দিচ্ছিলেন নাসুম আহমেদ। কিন্তু হৃদয়ই আগে সাজঘরে ফেরত যান। ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৮১ বলে ৫৪ রান করে শামীকে তুলে মারতে গিয়ে তিলক ভার্মার হাতে ক্যাচ দেন। তার বিদায়ের পরও দলের রান বেশ ভালোই হয়েছে। শেষের দিকের ব্যাটাররা রান করতে পারেন না, দলের এমন আফসোস দূর করেন নাসুম।
এই ব্যাটার দুর্দান্ত ব্যাট করেন। ৬ চার ও ১ ছক্কায় ৪৫ বলে ৪৪ রান করে আউট হন। তার বিদায়ের পরও দলের রান এগিয়ে যায়। মাহেদী হাসান ও অভিষিক্ত তানজিম সাকিব জুটিতে যোগ করেন ২৭ রান। ২৩ বলে ২৯ রান করে মাহেদী ও ৮ বলে ১৪ রান করে অপরাজিত থাকেন তানজিম সাকিব। বাংলাদেশ পায় ভালোভাবে লড়াই করতে পারার মতো সংগ্রহ। ভারতের হয়ে ১০ ওভারে ৬৫ রান দিয়ে তিনটি উইকেট শিকার করেন শার্দুল ঠাকুর। এছাড়াও মোহাম্মদ শামি নেন দুই উইকেট এবং একটি করে উইকেট শিকার করেন আক্সার প্যাটেল, রবীন্দ্র জাদেজা ও প্রসিধ কৃষ্ণা।