নিজস্ব প্রতিবেদক :
বর্ণিল আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো বাংলা নববর্ষ ১৪৩০-এর মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানকে প্রতিপাদ্য ধারণ করে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষের উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। নতুন বছরে শান্তিময় পৃথিবীর প্রত্যাশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে এ শোভাযাত্রা। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড় প্রদক্ষিণ করে টিএসসি হয়ে আবার চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। তার নেতৃত্বে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ শোভাযাত্রায় অংশ নেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
শোভাযাত্রার আগে সরেজমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যায়, এ আয়োজনকে সফল করতে ভোর থেকেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন আয়োজকরা। সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর জন্য অপেক্ষা করেন বিভিন্ন নানা বয়সী ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সকাল ৯টা বাজার আগেই বৈশাখী সাজে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা চারুকলা প্রাঙ্গণে জড়ো হন। মুখে রংতুলিতে লেখা ‘শুভ নববর্ষ ১৪২৯’, ‘এসো হে বৈশাখ’। পুরুষরা লাল-সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় গামছা, আর লুঙ্গি পরে নিজেকে পুরো বাঙালিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীরা পড়েছেন বৈশাখী শাড়ি। ছোট্ট শিশুরাও অভিভাবকদের সঙ্গে উৎসবে যোগ দেন।
বরাবরের মতো নিরাপত্তা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। র্যালির সম্মুখভাগে সোয়াতের টিম, র্যাব, পুলিশের চৌকস দল অবস্থান নেয়। কারো হাতে জাতীয় পতাকা, কারো হাতে চারুকলার তৈরি মুখোশ। এ ছাড়া র্যালির অগ্রভাবে টেপা পুতুল, ময়ূর, নীল গাই, হাতি, ভেড়ার বাচ্চা ও সর্বশেষ বাঘের প্রতিকৃতি ছিল।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন রমজান মাস হওয়ায় এবারের পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়নি। আর প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে শিশু ও বয়স্কদের উপস্থিতি কিছুটা কম।
তবে পুরোনো গ্লানি, হতাশা আর মলিনতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় নতুন বছর বরণ করতে কোনো অনীহা নেই তরুণদের মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হওয়ার আগে থেকেই তাদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বর, দোয়েল চত্বরে তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। এছাড়া শোভাযাত্রায় অংশ নিতে প্রতি বছরের ন্যায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উপস্থিত হয়েছেন।
এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ টিএসসি এলাকায় এসেছেন।
এবার এ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। এর মাধ্যমে সবার কামনা–পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক
এতে স্থান পেয়েছে পাঁচটি মোটিফ। এগুলো হলো: টেপা পুতুল, ময়ূর, নীল গাই, হাতি ও বাঘ। এর মধ্যে এবারের শোভাযাত্রায় নতুন সংযোজন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী নীল গাই। এর মাধ্যমে প্রাণীটিকে প্রকৃতিতে ফিরে পাওয়ার আশার পাশাপাশি বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা সব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আহ্বান জানানো হয়।
একই সঙ্গে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মুখোশ, পেঁচা, ঘোড়া, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাহিদা সুলতানার বলেন, প্রতিবছরই এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে থাকি। এবার রমজান মাস থাকায় সীমিত আকারে শোভাযাত্রা আয়োজিত হলেও অনেক ভালো লেগেছে।
পরিবার সমেত শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন নূর হোসাইন। তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের একটি অংশ। এ উৎসবের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় করানোর জন্যই আজ এসেছি।
বেসরকারি চাকরিজীবী জুবায়ের মাহমুদ বলেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপন মানেই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ। তাই সকাল সকাল চলে আসা। এবারে ছোট আকারে হলেও ভালো লেগেছে।
এবারের প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য নিয়ে নববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নিসার হোসেন বলেন, এবারের প্রতিপাদ্য ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। প্রতিবছর আমরা বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই প্রতিপাদ্য ঠিক করি। বর্তমানে মানুষের মাঝে হানাহানি, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তার চরম মাত্রায় পৌঁছেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও চরম ধস নেমেছে। তাই আমাদের এবারের কামনা পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক।
এদিকে শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢোলের তালে তালে নাচতে শুরু করেন অংশগ্রহণকারীরা। অনেকেই রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা উপভোগ করেন। এতে অংশ নিতে দেখা গেছে বিদেশি নাগরিকদেরও, যারা সেজেছেনও বাঙালির সাজে।
আয়োজক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, মাহে রমজানের পবিত্রতার কথা মাথায় রেখে বাঁশি, ভুভুজেলা নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ঢোলের শব্দও সীমিত রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেবারই এ উৎসব সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এরপর থেকে বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে এটি। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। পরে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে এ শোভাযাত্রা।