Dhaka বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শরীয়তপুর-ঢাকা সড়ক এখন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম, দুর্ঘটনার ভয়ে সন্ত্রস্ত পথযাত্রীরা

শরীয়তপুর জেলা প্রতিনিধি : 

পদ্মা সেতু পেরিয়ে যখন শরীয়তপুরের পথে নামেন, তখন মনে হয় উন্নয়নের গল্পটা এখানেই এসে থেমে গেছে। সেতুর চকচকে কংক্রিট আর উজ্জ্বল আলোর পর শুরু হয় ধুলা, খানাখন্দ আর ভাঙা রাস্তায় ভরা এক নতুন অধ্যায়। ভরসা হারানো মানুষ, দুলতে থাকা যানবাহন আর প্রতিদিনের দুর্ঘটনার ভয়ে সন্ত্রস্ত পথযাত্রীরা যেন এখন শরীয়তপুর-ঢাকা সড়কের স্থায়ী সঙ্গী।

চার বছর আগে এই সড়কটি উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল। এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ২৭ কিলোমিটার সড়ক হবে চার লেন, পাশে থাকবে সার্ভিস রোড— এমন প্রতিশ্রুতিতে জেগে উঠেছিল আশার আলো। কিন্তু সময় পেরিয়েছে চার বছর, আর শরীয়তপুরবাসী পেয়েছে ধুলা, কাদা আর যানজটের যন্ত্রণা।

শরীয়তপুর সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছিল এই প্রকল্প। একটিতে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাকি দু’টি প্যাকেজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় পড়ে গেছে। নাওডোবা গোলচত্বর থেকে টি-অ্যান্ড-টি মোড় পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক অংশের কাজ থমকে আছে মাসের পর মাস। অনেক স্থানে মাটি কেটে রাখা, কোথাও অসমাপ্ত ব্রিজের অ্যাপ্রোচে থেমে থাকা ইট-বালুর স্তূপ— সব মিলিয়ে পথটা যেন এক নির্মাণ বর্জ্যের জঙ্গল।

কাজিরহাটের ট্রাকচালক শাহিন চৌকিদার বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে আসতেই মনে হয় যেন রাস্তায় নয়, মাঠের ভেতর গাড়ি চালাচ্ছি। বৃষ্টি হলে চাকা কাদায় আটকে যায়, রোদ হলে ধুলায় চোখ-মুখ ভরে যায়। গাড়ি চালাতে গিয়েই ভয় লাগে— কখন উল্টে যাই।

একই ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীবাহী বাসচালক রফিক মিয়া। তিনি বলেন, ঢাকায় এক ট্রিপে আমাদের গাড়ির যন্ত্রাংশের ক্ষতি যা হয়, তাতে মাস শেষে মুনাফা নয়, উল্টো লোকসান গুনতে হয়। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল উন্নয়ন হয়েছে, অথচ এর পাশের রাস্তা এমন ভাঙাচোরা কেন থাকবে বুঝতে পারি না।

নাওডোবা ইউনিয়নের বাসিন্দা আজগর ঢালী বলেন, তিন বছর ধরে আমরা ধুলার মধ্যে বসবাস করছি। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিতে গেলে ঝাঁকুনিতে আরও বিপদ হয়। পদ্মা সেতুর ছায়ায় থেকেও আমরা যেন উন্নয়নের আলো পাইনি।

একই সুরে কথা বলেন এক শিক্ষার্থী। তার নাম তাসমিয়া আক্তার। তিনি বলেন, স্কুলে যেতে প্রতিদিন ভয়ে থাকি— কখন গাড়ি উল্টে পড়ে। ধুলোয় নাক-মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন চলা মানে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা থাকায় কিছু অংশের কাজ থেমে আছে। জেলা প্রশাসন থেকে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। আমাদের আশা, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে।

এদিকে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিন বেগম জানান, আমরা ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করছি। যে-সব এলএ কেস বাকি আছে, সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই ভূমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

পদ্মা সেতুর মতো মহাপ্রকল্প যেখানে দেশের অর্থনীতিকে গতি দিয়েছে, সেখানে সেই সেতুর পাশের সড়কই যেন উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ধুলায় ঢাকা মুখ, যানবাহনের কষ্ট, ব্যবসায়ীদের লোকসান আর সাধারণ মানুষের প্রতীক্ষা— সব মিলিয়ে শরীয়তপুরের এই সড়ক এখন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম।

তবু আশাবাদী মানুষগুলো এখনও স্বপ্ন দেখে— একদিন হয়ত পদ্মা সেতু পেরিয়ে শরীয়তপুরে পৌঁছালে ধুলা-কাদা নয়, মিলবে এক মসৃণ পথ।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

বিএমইউতে পুরোদমে চালু হলো অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট

শরীয়তপুর-ঢাকা সড়ক এখন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম, দুর্ঘটনার ভয়ে সন্ত্রস্ত পথযাত্রীরা

প্রকাশের সময় : ০১:০৪:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

শরীয়তপুর জেলা প্রতিনিধি : 

পদ্মা সেতু পেরিয়ে যখন শরীয়তপুরের পথে নামেন, তখন মনে হয় উন্নয়নের গল্পটা এখানেই এসে থেমে গেছে। সেতুর চকচকে কংক্রিট আর উজ্জ্বল আলোর পর শুরু হয় ধুলা, খানাখন্দ আর ভাঙা রাস্তায় ভরা এক নতুন অধ্যায়। ভরসা হারানো মানুষ, দুলতে থাকা যানবাহন আর প্রতিদিনের দুর্ঘটনার ভয়ে সন্ত্রস্ত পথযাত্রীরা যেন এখন শরীয়তপুর-ঢাকা সড়কের স্থায়ী সঙ্গী।

চার বছর আগে এই সড়কটি উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল। এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ২৭ কিলোমিটার সড়ক হবে চার লেন, পাশে থাকবে সার্ভিস রোড— এমন প্রতিশ্রুতিতে জেগে উঠেছিল আশার আলো। কিন্তু সময় পেরিয়েছে চার বছর, আর শরীয়তপুরবাসী পেয়েছে ধুলা, কাদা আর যানজটের যন্ত্রণা।

শরীয়তপুর সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছিল এই প্রকল্প। একটিতে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাকি দু’টি প্যাকেজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় পড়ে গেছে। নাওডোবা গোলচত্বর থেকে টি-অ্যান্ড-টি মোড় পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক অংশের কাজ থমকে আছে মাসের পর মাস। অনেক স্থানে মাটি কেটে রাখা, কোথাও অসমাপ্ত ব্রিজের অ্যাপ্রোচে থেমে থাকা ইট-বালুর স্তূপ— সব মিলিয়ে পথটা যেন এক নির্মাণ বর্জ্যের জঙ্গল।

কাজিরহাটের ট্রাকচালক শাহিন চৌকিদার বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে আসতেই মনে হয় যেন রাস্তায় নয়, মাঠের ভেতর গাড়ি চালাচ্ছি। বৃষ্টি হলে চাকা কাদায় আটকে যায়, রোদ হলে ধুলায় চোখ-মুখ ভরে যায়। গাড়ি চালাতে গিয়েই ভয় লাগে— কখন উল্টে যাই।

একই ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীবাহী বাসচালক রফিক মিয়া। তিনি বলেন, ঢাকায় এক ট্রিপে আমাদের গাড়ির যন্ত্রাংশের ক্ষতি যা হয়, তাতে মাস শেষে মুনাফা নয়, উল্টো লোকসান গুনতে হয়। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল উন্নয়ন হয়েছে, অথচ এর পাশের রাস্তা এমন ভাঙাচোরা কেন থাকবে বুঝতে পারি না।

নাওডোবা ইউনিয়নের বাসিন্দা আজগর ঢালী বলেন, তিন বছর ধরে আমরা ধুলার মধ্যে বসবাস করছি। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিতে গেলে ঝাঁকুনিতে আরও বিপদ হয়। পদ্মা সেতুর ছায়ায় থেকেও আমরা যেন উন্নয়নের আলো পাইনি।

একই সুরে কথা বলেন এক শিক্ষার্থী। তার নাম তাসমিয়া আক্তার। তিনি বলেন, স্কুলে যেতে প্রতিদিন ভয়ে থাকি— কখন গাড়ি উল্টে পড়ে। ধুলোয় নাক-মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন চলা মানে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা থাকায় কিছু অংশের কাজ থেমে আছে। জেলা প্রশাসন থেকে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। আমাদের আশা, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে।

এদিকে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিন বেগম জানান, আমরা ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করছি। যে-সব এলএ কেস বাকি আছে, সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই ভূমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

পদ্মা সেতুর মতো মহাপ্রকল্প যেখানে দেশের অর্থনীতিকে গতি দিয়েছে, সেখানে সেই সেতুর পাশের সড়কই যেন উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ধুলায় ঢাকা মুখ, যানবাহনের কষ্ট, ব্যবসায়ীদের লোকসান আর সাধারণ মানুষের প্রতীক্ষা— সব মিলিয়ে শরীয়তপুরের এই সড়ক এখন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম।

তবু আশাবাদী মানুষগুলো এখনও স্বপ্ন দেখে— একদিন হয়ত পদ্মা সেতু পেরিয়ে শরীয়তপুরে পৌঁছালে ধুলা-কাদা নয়, মিলবে এক মসৃণ পথ।