নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানীর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল শনিবার (৭ অক্টোবর) উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ টার্মিনালের মাধ্যমে সহজ ও স্বল্প সময়েই ইমিগ্রেশন করতে পারবেন যাত্রীরা।
নতুন প্রযুক্তি সংবলিত তৃতীয় টার্মিনাল এখন শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যেখানে পৌছাতে থাকবে না কোন যাত্রা ভোগান্তি। ইতোমধ্যে কাজ শেষ প্রায় ৯০ শতাংশ। শনিবার এই মহাযজ্ঞের আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৃতীয় টার্মিনালের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
উদ্বোধন উপলক্ষে তৃতীয় টার্মিনালে মঞ্চ তৈরিরসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। শনিবার সকাল ১০টায় তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হবে। পরে দুপুর ১২টায় বিমানবন্দর সংলগ্ন মাঠে সুধী সমাবেশ করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দুই অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে যাত্রী চলাচলের জন্য টার্মিনালটি প্রস্তুত হতে সময় লাগবে আরও একবছর। ২০২৪ সালের শেষে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহারের সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। এতে বিমানবন্দরে দুটি টার্মিনালে যাত্রীর চাপ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলায় নতুন টার্মিনালে স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীরা আরও ভালো সেবা পাবেন বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের পর বিমানবন্দরের চিত্র পাল্টে যাবে।
বর্তমানে দেশের বড় এই বিমানবন্দরে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। প্রথম টার্মিনাল অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের জন্য এবং দ্বিতীয় টার্মিনাল বিদেশে আসা-যাওয়ার জন্য। দুই টার্মিনাল ব্যবহার করে প্রতিদিন দেশ ও বিদেশের ৩০টি বিমান কোম্পানির ১২০ থেকে ১৩০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে প্রতিদিন যাত্রী চলাচল করেন ১৯ থেকে ২১ হাজারের মতো। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন।
তৃতীয় টার্মিনাল পুরদস্তুর চালু হলে বর্তমানের তুলনায় আরও এক কোটি ২০ লাখ অতিরিক্ত যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ তখন বছরে প্রায় দুই কোটিরও বেশি যাত্রী চলাফেরা করতে পারবেন এই বিমানবন্দর দিয়ে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. শফিউল আজিম জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এর সফট ওপেনিং এর জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সম্পূর্ণ প্রস্তুত। টার্মিনাল-৩ এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য নতুন ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া, দায়িত্ব পালনকারী জনবলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের নতুন ইউনিফর্ম প্রস্তুত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল শনিবার তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন একটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট এখান থেকে পরিচালনা করা হবে। আগামী বছরের শেষের দিকে যাত্রীরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারবেন এই টার্মিনাল। নির্মাণ কাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দর যাত্রীদের ব্যবহার করতে দেয়ার আন্তর্জাতিক নিয়ম নেই।
মফিদুর রহমান বলেন, তবে এটি নিঃসন্দেহে বলতে হয়, তৃতীয় টার্মিনাল বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতে আমূল পরির্বতন আনবে। বহুগুণে বাড়বে যাত্রীসেবার মান। বর্তমানে বছরে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ বিমানবন্দরে সেবা নিচ্ছে। বিমানবন্দরটি যখন পুরোপুরি চালু হবে তখন এক কোটি ২০ লাখের মতো মানুষ সেবা পাবে। এটা হবে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বিমানবন্দর। ধীরে ধীরে বিমানবন্দরে সক্ষমতা বাড়বে। বর্তমানে নতুন নতুন অনেক এয়ারলাইন্স থার্ড টার্মিনাল ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর। সে সময় ব্যয় ধরা হয় ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে আরও ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। নতুন করে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়লে প্রকল্পের ব্যয় হবে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
খরচের বেশিরভাগ আসছে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটি ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
বেবিচক কর্মকর্তারা জানান, তৃতীয় টার্মিনালকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে ব্রুনাই ও মরিশাসের সঙ্গে উড়োজাহাজ চলাচল চুক্তি হয়েছে। কয়েক দিন আগে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। এ ছাড়া অচিরেই চুক্তি হচ্ছে ইথিওপিয়ার সঙ্গে। সাইপ্রাস, লেবাননসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গেও চুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এ ছাড়া আরও অনেক দেশের সিভিল এভিয়েশন বাংলাদেশের সঙ্গে উড়োজাহাজ চলাচলের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের সঙ্গেও চুক্তির বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাইকার অর্থায়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে নির্মাণাধীন এ টার্মিনালের ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
এরই মধ্যে এ বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিমান চলাচলবিষয়ক চুক্তি হয়েছে। আরও অনেক দেশের সিভিল এভিয়েশন বাংলাদেশের সঙ্গে বিমান চলাচলের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের সঙ্গেও চুক্তির বিষয়টি বিবেচনাধীন বলেও তিনি জানান।
দেশের এভিয়েশন খাতের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। যতটা সম্ভব কাজ সারিয়ে নিতে জোর প্রচেষ্টা চলছে। দিনরাত বিশাল কর্মযজ্ঞকে ত্বরান্বিত করতে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ময়লা পরিষ্কার ও ধোয়া-মুছার কাজ। বেবিচক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিলে কাজগুলো তদারিক করছে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে প্রথম বোডিং ব্রিজটি প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেটি সাধারণ ও ভিআইপি যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারবেন। এজন্য উদ্বোধনের দিন ট্রায়াল রান হিসেবে একটি বিমান সেখান থেকে অবতরণ করবে। আর বোডিং গেটগুলো লাগানো হয়েছে এয়ারক্রাফটের ধরন অনুযায়ী।
এভিয়েশন খাতে অপার সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হচ্ছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। এ টার্মিনালের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ভবিষ্যতে মেট্রোরেল এবং বাস র্যাপিড ট্রানজিটসহ (বিআরটি) যোগাযোগের সব মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই টার্মিনাল। ফলে কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহজেই বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করতে পারবেন যাত্রীরা।
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, নতুন টার্মিনালে নানা সুবিধা দেয়ার জন্য ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১৫টি বহির্গমন চেক-ইন কাউন্টার, ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টার, ৬৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার, ৫টি স্বয়ংক্রিয় আগমনী চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার, ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট, ২৭টি হোল্ড ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি কেবিন ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৫২টি মেটাল ডিটেক্টর, ১১টি বডি স্ক্যানার মেশিন। এ ছাড়াও থাকছে হাজারের বেশি গাড়ি পার্কিং করার মাল্টিলেভেল কার পার্কিং।
পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের নতুন টার্মিনাল চালু হলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে এখানে। এই টার্মিনালে বহির্গমনের জন্য মোট চেক-ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি। এর মধ্যে ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টার।
বহির্গমনের জন্য ইমিগ্রেশন কাউন্টার হবে ৬৬টি। এর মধ্যে ১০টি হবে স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টার। আগমনের জন্য মোট কাউন্টার থাকবে ৫৯টি। এর মধ্যে ৫টি স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টার। তৃতীয় টার্মিনালে ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে ১৬টি। গাড়ি পার্কিংয়ের তৈরি করা হয়েছে বহুতল পার্কিং ব্যবস্থা। ১ হাজার ৪৪টি গাড়ি সেখানে পার্ক করে রাখা যাবে।
তৃতীয় টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। এ ছাড়াও থাকবে সুপরিসর ডিউটি ফ্রি দোকান ও বহির্গমন লাউঞ্জ।
বহির্গমনের জন্য স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টার থাকায় যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করাতে পারবেন। এজন্য তাদের পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না।
বেবিচক সূত্র জানায়, এই টার্মিনালে লাগানো স্ক্যানিং মেশিনগুলো অত্যাধুনিক। যারা লাগেজ দেবেন সেগুলো অটো স্ক্যানিং হবে। এগুলো আগের মেশিনগুলো থেকে আরও বেশি আধুনিক। আগে এয়ারক্রাফটে ঢোকার আগে চেক করতে হতো কিন্তু নতুন মেশিনে সেটি আর করতে হবে না। যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে টার্মিনালে মুভি ওয়াকার (হাঁটার জন্য চলন্ত রাস্তা) রয়েছে। আর এগুলো থাকছে পুরো টার্মিনালজুড়ে। ফলে যাত্রীকে হাঁটতে তেমন বেগ পেতে হবে না। যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরগুলোতে দেখা যায়।
টার্মিনালটির ভবনের যাবতীয় কার্যক্রম চালাতে দিনে কোনো বিদ্যুৎ লাগবে না। বাড়তি বাতির প্রয়োজন হবে না। এজন্য ভবনটির চারপাশে গ্লাস বসানো হয়েছে এবং ওপরের দিকে স্কাই লাইট রাখা হয়েছে, যাতে সহজে দিনের আলো আসে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।