Dhaka মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শত বছরেও কেন আরেকজন রোকেয়া তৈরি হলো না : প্রধান উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রয়াণের প্রায় শত বছর হতে চললেও তার মতো কেউ তৈরি হলো না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তিনি যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, যেসব স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, সেই স্বপ্নকে আমরা আমলে আনতে পারিনি, অগ্রসর হতে পারিনি।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন বলেন, বেগম রোকেয়ার জন্ম উপলক্ষে যে আয়োজন, সেটা শুধু তাকে স্মরণ করার জন্য না, আমাদের ব্যর্থতাগুলো খুঁজে বের করার জন্য, কেন আমরা ব্যর্থ হলাম, কেন এই ১০০ বছরেও আরও বেগম রোকেয়া আসলো না আমাদের মাঝে, যে আমাদের পথ দেখাতো, মনে করিয়ে দিত কোন পথে আমাদের যাওয়া দরকার।

তিনি বলেন, ১০০ বছর পরে কি হলো, কত অগ্রসর হলাম। ১৯৭৪ সালে একটা বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। পথে পথে মানুষ মারা গেল। আমরা নির্বাক তাকিয়ে দেখলাম। কিছুই করলাম না। তাদের মধ্যে বহু নারী ও বৃদ্ধ। কারও হিসাবে ওই দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুর দিককার স্মৃতিচারণ করে নারীদের কঠিন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের আঘাত প্রথমে আসে মেয়েদের ওপরে, শিশুদের ওপরে।’

‘আমরা দেখলাম, মেয়েরা জানে না তাদের নাম কী? সবাই চিনে, অমুকের মা, অমুকের স্ত্রী, অমুকের মেয়ে, নাতি-নাতনি। নাম জানে না। সমাজের একটা অংশ কীভাবে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এটা তার নমুনা। আমরা নাম ঠিক করে দিলাম। নাম লিখতে শেখানোর জন্য হাতে কাঠি ধরিয়ে দিলাম। দিনরাত পরিশ্রম করে, চোখের পানি ফেলে তারা নাম লেখা শিখল… এটা ১০০ বছর পরের অবস্থা। ১০০ বছর আগে রোকেয়া সেই আমলে যে স্বপ্ন দেখেছে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আজকে অনেকে বলে, ‘হ্যাঁ, সুন্দর কথা বলেছে…’ সুন্দর কথা না, রোকেয়া বিপ্লবী কথা বলেছে। সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলেছে। কিন্তু সেই ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তি আর এলো না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া কোনো কাজ সমাজকে বাদ দিয়ে করেননি। সবসময় সমাজকে নিয়েই করেছে। ১০০ বছর আগে রোকেয়া লিখেছে, নারী-কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও যাতে সে অন্ন উপার্জন করতে পারে। সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? আয়োজন করছি কিন্তু শিখতে পারছি না। আমাদের দৈনন্দিন পথে রোকেয়া সাথে থাকুক, তাহলেই অগ্রসর হতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ি; ইকোনমিক্স অনার্সে অনেক ছেলে ছিল, মেয়ে ছিল মাত্র চার জন। কোনো কোনো বিভাগে কোনো মেয়েই ছিল না। এখন যেকোনো শিক্ষায়তনে যাও। মেয়ে শিক্ষার্থীরা উপচে পড়ছে। আমি খোঁজ নিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন অর্ধেক-অর্ধেক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েদের হল কয়টা? আমাকে বলল পাঁচটা। আর ছেলেদের হল ১৩টা। এটা কেমন বিচার হলো? মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা তো আগে করতে হবে।’

শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, যে মহিয়সী নারীর কথা স্মরণ করে আজকের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছে, সেই মহিয়সী নারীর আত্মা আজকে শান্তি পাবে। তিনি যে কল্পনা করেছিলেন, তার ইমাজিনেশনে তিনি যে সমাজ চিন্তা করেছিলেন; আজকে যারা পুরস্কার পেল, তারা সেই সমাজ নির্মাণের পাথেয় আমাদেরকে দিচ্ছে।

‘আমরা সারা জাতি তাদের উদাহরণ থেকে তাদের পথচলা থেকে শিক্ষা পাই এবং যে আদর্শে বেগম রোকেয়া আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, অতি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন তার বক্তব্যে, তার লেখায়; আজকে যে চারজন পুরস্কার পেলেন, তারা রোকেয়ার সেই পথে আমাদের জাতিকে তুলে ধরলেন, এগিয়ে দিলেন। আমরা ভাগ্যবান, আমরা ভাগ্যবতী।’

তৎকালীন সমাজের অচলায়তন ভেদ করে রোকেয়া যে নারীদের আলোর পথ দেখিয়েছিলেন, সে কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছে, সাংঘাতিক রকমের স্বপ্ন; এরকম স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে সে আমলে—যে পরিসরে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আজকে মনে হয় যে—হ্যাঁ, এটা তো সুন্দর কথা বলছে। সুন্দর কথা না; বিপ্লবী কথা। সমস্ত সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা, কিন্তু সে ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার লোক আর আসলো না। এটি হলো দুর্ভাগ্য; আমাদের দুর্ভাগ্য।’

নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন বেগম রোকেয়া, সেই প্রসঙ্গ ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘কীভাবে আমরা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বেগম রোকেয়াও নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে পারত, পেরেছিল। তার বহু কাজ ছিল। কিন্তু কোনো কাজের মধ্যে সে সমাজকে বাদ দিয়ে করেনি। সবসময় সমাজকে নিয়েই করেছে।’

নারীদের সামনে রেখেই নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মেয়েরা গণ-অভ্যুত্থানে তাদের নেতৃত্ব দেখিয়েছে। আজকের নারীসমাজ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নারী সমাজ। এটা ভিন্ন নারী সমাজ। তাদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই নারীসমাজ শুধু নারীদের নয়, সবাইকে উজ্জীবিত করবে। সেজন্যই নারীদের উঁচু স্তরে ধরে রাখা আমাদের জন্য দরকার। নারীদের সামনে রেখেই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।’

তিনি বলেন, ‘তার যে কল্পনা শক্তি তার সাহিত্যে সে প্রকাশ করেছে; যে ভবিষ্যৎ চিন্তা সে করেছে, একটা বাক্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলছে যে, নারী কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও—যাতে তার অন্ন উপার্জন করতে পারে। সে ১০০ বছর আগের কথা, ১৫০ বছর আগের কথা; অন্ন অর্জন করতে পারে।’

রোকেয়া চাকরি করার কথা বলেননি মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা বলছি—উদ্যোক্তা হতে হবে, এই হতে হবে; সে বহু কাল আগে এটা বলে চলে গেছে। শিক্ষা নিয়ে চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি করো, তোমার চাকরি কোথায় কোথায় আছে আমরা খুঁজে দিই, কিচ্ছু বলেনি। সে নিজের অন্নের ব্যবস্থা করবে। আর সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? উৎসব করছি, সব করছি। কিন্তু শিখতে পারছি না। আমাদের দৈনন্দিন পথে রোকেয়ার সঙ্গে থাকুন, তাহলেই সার্থকতা।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আর আজকে যারা পুরস্কার পেলেন, তারা শুধু বাংলাদেশের নয়। তারা বাংলাদেশকে অন্য একপর্যায়ে নিয়ে গেছে, প্রত্যেকে। এটা আরো একটি পুরস্কার নাম, এটা যুগান্তকারী পুরস্কার; যারা আমাদেরকে দুনিয়ার সামনে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। এরা শুধু বাংলাদেশের মেয়ে না, এরা সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দেওয়ার মেয়ে। কাজেই তাদেরকে যে আজকে আমরা পেয়েছি এই ছোট অনুষ্ঠানে সম্মান দেখানোর জন্য, সেটা তার প্রথম ধাপ।’

এর আগে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে চার নারীর হাতে রোকেয়া পদক তুলে দেন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। নারীশিক্ষা শ্রেণিতে (গবেষণা) রুভানা রাকিব, নারী অধিকার শ্রেণিতে (শ্রম অধিকার) কল্পনা আক্তার, মানবাধিকার শ্রেণিতে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী জাগরণ শ্রেণিতে (ক্রীড়া) পদক পন ঋতুপর্ণা চাকমা।

উল্লেখ্য, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছর রোকেয়া পদক দেয় বাংলাদেশ সরকার।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের একই তারিখে কলকাতার সোদপুরে তার মৃত্যু হয়।

রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থায় নারীর সমান অধিকারের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন মহিয়সী এই নারী।

বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পণ প্রথা, ধর্মের অপব্যাখ্যাসহ নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন রোকেয়া। মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি কালজয়ী গ্রন্থে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সমাজের কুসংস্কার ও নারীর বন্দিদশার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তিনি।

 

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ত‍্যাগ যেন বৃথা না যায় : মির্জা ফখরুল

শত বছরেও কেন আরেকজন রোকেয়া তৈরি হলো না : প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশের সময় : ০৩:২৮:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রয়াণের প্রায় শত বছর হতে চললেও তার মতো কেউ তৈরি হলো না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তিনি যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, যেসব স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, সেই স্বপ্নকে আমরা আমলে আনতে পারিনি, অগ্রসর হতে পারিনি।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন বলেন, বেগম রোকেয়ার জন্ম উপলক্ষে যে আয়োজন, সেটা শুধু তাকে স্মরণ করার জন্য না, আমাদের ব্যর্থতাগুলো খুঁজে বের করার জন্য, কেন আমরা ব্যর্থ হলাম, কেন এই ১০০ বছরেও আরও বেগম রোকেয়া আসলো না আমাদের মাঝে, যে আমাদের পথ দেখাতো, মনে করিয়ে দিত কোন পথে আমাদের যাওয়া দরকার।

তিনি বলেন, ১০০ বছর পরে কি হলো, কত অগ্রসর হলাম। ১৯৭৪ সালে একটা বিরাট দুর্ভিক্ষ হলো। পথে পথে মানুষ মারা গেল। আমরা নির্বাক তাকিয়ে দেখলাম। কিছুই করলাম না। তাদের মধ্যে বহু নারী ও বৃদ্ধ। কারও হিসাবে ওই দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুর দিককার স্মৃতিচারণ করে নারীদের কঠিন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের আঘাত প্রথমে আসে মেয়েদের ওপরে, শিশুদের ওপরে।’

‘আমরা দেখলাম, মেয়েরা জানে না তাদের নাম কী? সবাই চিনে, অমুকের মা, অমুকের স্ত্রী, অমুকের মেয়ে, নাতি-নাতনি। নাম জানে না। সমাজের একটা অংশ কীভাবে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এটা তার নমুনা। আমরা নাম ঠিক করে দিলাম। নাম লিখতে শেখানোর জন্য হাতে কাঠি ধরিয়ে দিলাম। দিনরাত পরিশ্রম করে, চোখের পানি ফেলে তারা নাম লেখা শিখল… এটা ১০০ বছর পরের অবস্থা। ১০০ বছর আগে রোকেয়া সেই আমলে যে স্বপ্ন দেখেছে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আজকে অনেকে বলে, ‘হ্যাঁ, সুন্দর কথা বলেছে…’ সুন্দর কথা না, রোকেয়া বিপ্লবী কথা বলেছে। সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলেছে। কিন্তু সেই ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তি আর এলো না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া কোনো কাজ সমাজকে বাদ দিয়ে করেননি। সবসময় সমাজকে নিয়েই করেছে। ১০০ বছর আগে রোকেয়া লিখেছে, নারী-কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও যাতে সে অন্ন উপার্জন করতে পারে। সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? আয়োজন করছি কিন্তু শিখতে পারছি না। আমাদের দৈনন্দিন পথে রোকেয়া সাথে থাকুক, তাহলেই অগ্রসর হতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ি; ইকোনমিক্স অনার্সে অনেক ছেলে ছিল, মেয়ে ছিল মাত্র চার জন। কোনো কোনো বিভাগে কোনো মেয়েই ছিল না। এখন যেকোনো শিক্ষায়তনে যাও। মেয়ে শিক্ষার্থীরা উপচে পড়ছে। আমি খোঁজ নিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন অর্ধেক-অর্ধেক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েদের হল কয়টা? আমাকে বলল পাঁচটা। আর ছেলেদের হল ১৩টা। এটা কেমন বিচার হলো? মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা তো আগে করতে হবে।’

শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, যে মহিয়সী নারীর কথা স্মরণ করে আজকের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছে, সেই মহিয়সী নারীর আত্মা আজকে শান্তি পাবে। তিনি যে কল্পনা করেছিলেন, তার ইমাজিনেশনে তিনি যে সমাজ চিন্তা করেছিলেন; আজকে যারা পুরস্কার পেল, তারা সেই সমাজ নির্মাণের পাথেয় আমাদেরকে দিচ্ছে।

‘আমরা সারা জাতি তাদের উদাহরণ থেকে তাদের পথচলা থেকে শিক্ষা পাই এবং যে আদর্শে বেগম রোকেয়া আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, অতি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন তার বক্তব্যে, তার লেখায়; আজকে যে চারজন পুরস্কার পেলেন, তারা রোকেয়ার সেই পথে আমাদের জাতিকে তুলে ধরলেন, এগিয়ে দিলেন। আমরা ভাগ্যবান, আমরা ভাগ্যবতী।’

তৎকালীন সমাজের অচলায়তন ভেদ করে রোকেয়া যে নারীদের আলোর পথ দেখিয়েছিলেন, সে কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছে, সাংঘাতিক রকমের স্বপ্ন; এরকম স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে সে আমলে—যে পরিসরে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আজকে মনে হয় যে—হ্যাঁ, এটা তো সুন্দর কথা বলছে। সুন্দর কথা না; বিপ্লবী কথা। সমস্ত সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা, কিন্তু সে ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার লোক আর আসলো না। এটি হলো দুর্ভাগ্য; আমাদের দুর্ভাগ্য।’

নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন বেগম রোকেয়া, সেই প্রসঙ্গ ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘কীভাবে আমরা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বেগম রোকেয়াও নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে পারত, পেরেছিল। তার বহু কাজ ছিল। কিন্তু কোনো কাজের মধ্যে সে সমাজকে বাদ দিয়ে করেনি। সবসময় সমাজকে নিয়েই করেছে।’

নারীদের সামনে রেখেই নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মেয়েরা গণ-অভ্যুত্থানে তাদের নেতৃত্ব দেখিয়েছে। আজকের নারীসমাজ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নারী সমাজ। এটা ভিন্ন নারী সমাজ। তাদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই নারীসমাজ শুধু নারীদের নয়, সবাইকে উজ্জীবিত করবে। সেজন্যই নারীদের উঁচু স্তরে ধরে রাখা আমাদের জন্য দরকার। নারীদের সামনে রেখেই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।’

তিনি বলেন, ‘তার যে কল্পনা শক্তি তার সাহিত্যে সে প্রকাশ করেছে; যে ভবিষ্যৎ চিন্তা সে করেছে, একটা বাক্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলছে যে, নারী কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও—যাতে তার অন্ন উপার্জন করতে পারে। সে ১০০ বছর আগের কথা, ১৫০ বছর আগের কথা; অন্ন অর্জন করতে পারে।’

রোকেয়া চাকরি করার কথা বলেননি মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা বলছি—উদ্যোক্তা হতে হবে, এই হতে হবে; সে বহু কাল আগে এটা বলে চলে গেছে। শিক্ষা নিয়ে চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি করো, তোমার চাকরি কোথায় কোথায় আছে আমরা খুঁজে দিই, কিচ্ছু বলেনি। সে নিজের অন্নের ব্যবস্থা করবে। আর সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? উৎসব করছি, সব করছি। কিন্তু শিখতে পারছি না। আমাদের দৈনন্দিন পথে রোকেয়ার সঙ্গে থাকুন, তাহলেই সার্থকতা।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আর আজকে যারা পুরস্কার পেলেন, তারা শুধু বাংলাদেশের নয়। তারা বাংলাদেশকে অন্য একপর্যায়ে নিয়ে গেছে, প্রত্যেকে। এটা আরো একটি পুরস্কার নাম, এটা যুগান্তকারী পুরস্কার; যারা আমাদেরকে দুনিয়ার সামনে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। এরা শুধু বাংলাদেশের মেয়ে না, এরা সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দেওয়ার মেয়ে। কাজেই তাদেরকে যে আজকে আমরা পেয়েছি এই ছোট অনুষ্ঠানে সম্মান দেখানোর জন্য, সেটা তার প্রথম ধাপ।’

এর আগে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে চার নারীর হাতে রোকেয়া পদক তুলে দেন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। নারীশিক্ষা শ্রেণিতে (গবেষণা) রুভানা রাকিব, নারী অধিকার শ্রেণিতে (শ্রম অধিকার) কল্পনা আক্তার, মানবাধিকার শ্রেণিতে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী জাগরণ শ্রেণিতে (ক্রীড়া) পদক পন ঋতুপর্ণা চাকমা।

উল্লেখ্য, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছর রোকেয়া পদক দেয় বাংলাদেশ সরকার।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের একই তারিখে কলকাতার সোদপুরে তার মৃত্যু হয়।

রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থায় নারীর সমান অধিকারের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন মহিয়সী এই নারী।

বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পণ প্রথা, ধর্মের অপব্যাখ্যাসহ নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন রোকেয়া। মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি কালজয়ী গ্রন্থে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সমাজের কুসংস্কার ও নারীর বন্দিদশার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তিনি।