নিজস্ব প্রতিবেদক :
এক সপ্তাহ পরেই শুরু হবে পবিত্র মাহে রমজান। অথচ রোজার আগেই হু হু করে বাড়ছে শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। সবজিভেদে কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা করে। দুই একটি ছাড়া কোনও সবজিই ৪০ থেকে ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যে দাম বাড়লেও বাড়েনি আয়। এছাড়া নতুন করে ব্রয়লার মুরগির দাম না বাড়লেও গত সপ্তাহের মতো ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে পাকিস্তানি কর্ক ও দেশি মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে। এদিকে দাম কমার মধ্যে শুধু রয়েছে ছোলা। রোজাকে কেন্দ্র করে এভাবে দাম বাড়তে থাকলে ইফতার-সেহরিতে খাদ্য সংগ্রহই কঠিন হয়ে পড়বে।
শুক্রবার (১৭ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে তুলনামূলক প্রায় প্রতিটি সবজিরই দাম বেড়েছে। দুই একটি ছাড়া কোনও সবজিই ৪০ থেকে ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। সজনে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে, ঢেঁড়স ১০০ থেকে ১১০ টাকায়, করলা ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজিতে। কেজিপ্রতি সিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, পটল ৮০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, আলু পোলান্ড ৩০, দেশি ছোট আলু ৪০ টাকা, পেঁপে ৫০ টাকা এবং বরবটি ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও কাঁচামরিচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, ফুলকপি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকা, এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।
ক্রেতা ও বিক্রেতারা বলছেন, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজিতে অন্তত ১০-২০ টাকা বেড়েছে। বিশেষ করে নতুন সবজির দাম বেড়েছে বেশি। রমজানের শুরুতে এই দাম আরও কিছুটা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিক্রেতারা।
মালিবাগ কাঁচা বাজারের বিক্রেতা সফিউজ্জামান বলেন, কয়েকদিন ধরেই সবজির দাম বাড়তি। নতুন সজনে, বরবটি, কচুরলতি এখন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরোনো সবজির (শীতের সবজি) দামও বেড়েছে। তবে তুলনামূলক কম।
সবজি বিক্রেতা এনামুল হোসেন বলেন, শীতকালীন সবজি শেষ হয়ে যাওয়া এবং অনেক সবজির ক্ষেতে ধান লাগানোর কারণে উৎপাদন কমে গেছে। সেই কারণে সবজির সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়তি। এরমধ্যে রোজার প্রভাবও রয়েছে।
এই সবজি বিক্রেতা বলেন, রোজা শুরু হলে বেগুন, শসা, লেবু, টমেটো ও ধনেপাতার দাম কিছুটা বাড়তে পারে। সঙ্গে কাঁচামরিচও।
এদিকে বাজারভেদে ব্রয়লার মুরগি গত সপ্তাহের মতো ২৪০-২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্যান্য মুরগির দাম ২০-৫০ টাকা বেড়ে পাকিস্তানি মুরগি ৩৪০-৩৮০ টাকা ও বড় কর্ক মুরগি ৩২০-৩৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে দেশি মুরগির দাম এখন প্রতি পিস (৮০০-৯০০ গ্রাম) ৫০০-৫৫০ টাকা।
পাশাপাশি গরুর মাংসও প্রতি কেজি বাড়তি দামে ৭৫০ টাকায় এবং খাসির মাংস প্রতি কেজি ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মাছবাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য পণ্যের মতো সব ধরনের মাছেরই বাড়তি দাম যাচ্ছে। ক্রেতারা দাম শুনে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছেন। বাজারে পাঙাস মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, তেলাপিঁয়া আকৃতিভেদে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা, চাষের কই প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বাজারে বড় মাঝারি সাইজের শিং মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, ছোট শিং প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, টেংড়া প্রতি কেজি ৫০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, গলদা প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, মলা মাছ প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, কাতল মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, শোল মাছ প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আগে এই মাছগুলো তুলনামূলক কম থাকায় এসব মাছগুলোর প্রতি সাধারণ নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের চাহিদা বেশি থাকতো। ফলে বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো এসব মাছগুলোই, কিন্তু কিছুদিন ধরে এসব মাছগুলোরও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়ায় বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবি আনোয়ার হোসেন। মাছের বাজার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যেমন ইচ্ছে তেমনিভাবে চলছে বাজার, ইচ্ছেমতো সবাই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু মনিটরিংয়ের যেন কেউ নেই। মাছের দাম এতটা বাড়লে আমরা খাবো কি? দাম বৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই খাওয়া যায় না গরু, খাসির মাংস। পরে বাড়লো ব্রয়লারসহ অন্যান্য মুরগির দাম। এখন বাজারে দেখছি সব ধরণের মাছের দামই বাড়তি। আগে পাঙাস মাছ কিনতাম ১৫০/১৬০ টাকায় এখন সেই মাছের দাম বেড়ে ২২০ টাকা, চাষের কই মাছ কিনেছি ২৪০ টাকায় এখন সেটা ৩০০ টাকা। তেলাপিঁয়া মাছও ২৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। কম দামের মাছগুলোরও দাম বৃদ্ধির কারণে ছুঁয়েও দেখা যায় না। তাহলে আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতারা কি কিনবে? কি খাবে?
মাছের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গুলশান সংলগ্ন লেকপাড় মাছ বাজারের মাছ বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু দিন ধরে সব ধরণের মাছের দাম বাড়তি যাচ্ছে। পাঙাস, তেলাপিঁয়া, চাষের কই আগে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো সব বাজারেই কিন্তু এখন বাড়তি দামের কারণে এগুলোর বিক্রিও কমেছে। মূলত মাছের ফিডের দাম বৃদ্ধির পর থেকে মাছের দাম বাড়তি যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পাইকারি বাজারে হঠাৎ করেই বাড়তি দামে মাল কিনতে হচ্ছে যার প্রভাব সব খুচরা বাজারে পড়েছে। যখন যেমন দামে আমরা পাইকারি মাছ কিনে আনি, কিছুটা লাভ রেখে তেমন রেটেই বিক্রি করি। যখন কেনা ক্ষেত্রে কম দামে বাজার যাবে তখন আমরাও খুচরা বাজারে কম দামেই বিক্রি করতে পারবো।
রাজধানীর কচুক্ষেত ও ইব্রাহিমপুরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ছোলার দাম মানভেদে ৯০-৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও ছোলার দাম এমনি ছিল। এংকার ডাল কেজিতে ৫ টাকা কমে ৬৫ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১০০ টাকা, মোটা হাইব্রিড মসুর ডাল ১১০ টাকা, দেশি মসুর ডাল ১২০ টাকা ও মাসকালাইয়ের ডাল ২০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২০ টাকা কমে মুগ ডাল ১১০ টাকা ১১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খেসারি ডাল ৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
বেসন বিক্রি হচ্ছে ডালভেদে ৯৫ কেজি ১২০ টাকা। এংকার ডালের বেসন ৮০ টাকা, বুটের ডালের বেসন ৯৫ টাকা ও মুগ ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা।
কচুক্ষেত বাজারের মুদি দোকানি শাহজালাল বলেন, শবে বরাতের আগে বিভিন্ন প্রকারের ডাল ও ছোলার দাম যেভাবে বেড়েছিল, গত এক সপ্তাহে সেভাবে বাড়েনি। এককথায় বলতে গেলে রমজানের আগে ডালের দাম আর বাড়বে না বলে মনে হচ্ছে।
সেগুনবাগিচা বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরের সত্ত্বাধিকারী জামাল মিয়া বলেন, দাম যা বাড়ার আগেই বেড়েছে। এখন রমজানের যথেষ্ট পরিমাণ পণ্য আছে বাজারে। তাই নতুন করে বাড়েনি কিছু।
একই বাজারের শামীম এন্টারপ্রাইজের মালিক শামীম মিয়া বলেন, এলসি বন্ধ থাকায় ডাল ও ছোলার দাম একটু বেড়েছিল। কিন্তু রমজানের পণ্য হিসেবে ছোলা ও বিভিন্ন জাতের ডাল আমদানিতে সরকার এলসি খোলার সুযোগ দেয়। এমন হলে এসব পণ্য প্রচুর পরিমাণে আমদানি করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব বাজারে পড়েছে। বাজারে ডাল ও ছোলার পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এজন্য রমজানে এসব পণ্যের দাম বাড়বে না বরং রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এসব পণ্যের দাম কিছুটা কমতে পারে।
এদিকে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে- এমন খবরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৩৭ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে সেটা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকায়। রমজানে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা বাড়তি যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দোকানিরা।
বাজার করতে আসা সাজেদুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাজারে গরিবের মাছ হিসেবে যে পাঙাস, তেলাপিঁয়া পরিচিত সেই মাছেরও অতিরিক্ত দামে ছোঁয়াও যাচ্ছে না। শুধু দাম শুনে চলে আসতে হচ্ছে। বয়লার মুরগির যে দাম বেড়েছে সেটা জানি কিন্তু মাছের দামও যে এতটা বেড়ে গেছে তা জানা ছিল না।
বাজার করতে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, বর্তমান বাজারে সাধারণ পেশাজীবীদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তাদের অধিকাংশকেই জমানো পুঁজি ভেঙে, ধার-দেনা ও ঋণ করে টানাপড়েনে সংসার চালাতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই।