রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি :
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলায় তৃতীয় দিনের মতো দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে হঠাৎ বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয় বাস মালিক সমিতি। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে যাত্রীরা পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। জরুরি প্রয়োজনে অনেকেই বিকল্প পরিবহনে রওনা দিচ্ছেন গন্তব্যে। এতে যেমন ভোগান্তি বেড়েছে, তেমনি বাড়ছে যাতায়াত ব্যয়ও।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেও কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। যাত্রীরা বাসস্ট্যান্ডে এলেও বাস না পেয়ে কেউ ফিরে যাচ্ছেন, আবার কেউ বিকল্প গাড়িতে রওনা হচ্ছেন।
শ্রমিকরা জানায়, তাদের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক অভিযোগ তুলে গত তিনদিন ধরে গ্রামীণ ট্রাভেলস, হানিফ, দেশ ও ন্যাশনাল ট্যাভেলসের গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। এতে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারাও।
এদিকে হানিফ, দেশ, গ্রামীণ ট্রাভেলস ও ন্যাশনাল কোম্পানির গাড়িগুলো বন্ধ থাকায় একতা, আরপি এলিগেন্স, শ্যামলী ও লোকাল বাসগুলো তাদের গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে যাত্রী দুর্ভোগ লাঘবে কিছুটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুতই এর সমাধান চান সংশ্লিষ্ট সকলেই।
শ্রমিক নেতারা জানান, একই রুটে একতা পরিবহন শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিচ্ছে। কিন্তু ন্যাশনাল, হানিফ, গ্রামীণ ও দেশ ট্রাভেলস তাদের চালক ও কর্মচারীদের ন্যায্য মজুরি দিচ্ছে না।
তারা জানান, একতা পরিবহন রাজশাহী-ঢাকা রুটে যাত্রী নিয়ে একবার যাতায়াত করলে চালককে দৈনিক মজুরি দেওয়া হয় এক হাজার ৭৫০ টাকা। সুপারভাইজারকে দেওয়া হয় ৭৫০ টাকা এবং সহকারী পান ৭০০ টাকা। তবে গত ১৫ বছর ধরে ন্যাশনাল, হানিফ, গ্রামীণ, দেশ ট্রাভেলস চালককে দেয় এক হাজার ২৫০ টাকা। সুপারভাইজার ৫৭৫ টাকা এবং সহকারী পান ৫৫০ টাকা।
শ্রমিকরা বলেন, তারা একতা পরিবহনের নিয়মে পারিশ্রমিক চেয়ে তিন দফা কর্মবিরতি পালন করে বাস চলাচল বন্ধ করেছিলেন। সর্বশেষ গত সোমবার তারা গাড়ি চালাননি। মঙ্গলবার রাতে বৈঠকে মালিকপক্ষ বেতন বাড়াতে সম্মত হয়। শ্রমিকরা মঙ্গলবার থেকে আবারও কাজ শুরু করেন। কথা ছিল বৃহস্পতিবার থেকে তাদের বর্ধিত বেতন দেওয়া হবে। সকাল থেকে গাড়ি চালিয়ে শ্রমিকরা রাতে বেতন নিতে গেলে মালিকপক্ষ জানিয়ে দেয়, গাড়ি চালানোর প্রয়োজন নেই। এরপর বৃহস্পতিবার রাত থেকে আবারও বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাজশাহী থেকে বিভিন্ন রুটে একতা পরিবহনের ৩২টি বাস স্বাভাবিকভাবে চলছে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক অনেক বাসও যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে ঢাকার পথে। ফলে বাস চলাচল একেবারে বন্ধ না হলেও ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তরবঙ্গ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় পরিবহন নেতাদের সঙ্গে গত রাতে বসার কথা ছিল। তবে একজন নেতা অসুস্থ থাকায় বসা হয়নি। আজ বসা হবে। সেখানেই বিষয়টির সুরাহা হবে।
রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পাখি বলেন, শ্রমিকদের জিম্মি করতে হঠাৎ করে মালিকপক্ষ বাস চালানো বন্ধ ঘোষণা করে। এর আগে তারা বেতন বাড়াতে একমত হয়। হঠাৎ করে বাস বন্ধ করায় শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন। যাত্রীদের দুর্ভোগও বেড়েছে।
এদিকে মালিকপক্ষ বলছে, গত মঙ্গলবার বৈঠকে তারা বেতন বাড়াতে সম্মত হলেও শ্রমিকরা অযৌক্তিক আরও কিছু দাবি করেছে।
পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম হেলাল বলেন, শ্রমিকরা হোটেল বিল, মোবাইল বিল, বিনামূল্যে দুজন যাত্রীর টিকিটের বিল চায়। এসব অযৌক্তিক দাবি মেনে নিলে মালিকপক্ষের লোকসান হবে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা সমাধানের জন্য রাতে বৈঠক আছে। আশা করছি, ঠিক হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম পাখি বলেন, একজন চালক সকালে ঢাকার পথে রওনা দিলে বিকেলে পৌঁছান। আবার সন্ধ্যায় রওনা দিলে পরদিন ভোরে পৌঁছান। একবার যাতায়াত বলা হলেও এতে চালক, সুপারভাইজার ও হেলপারদের দুদিন চলে যায়। এখনকার বাজারে দুদিন খেটে এক হাজার ২৫০ টাকায় সংসার চলার কথা না। একই সময়ে সুপারভাইজার ও হেলপাররা পান সাড়ে ৫০০ টাকা। এত অল্প টাকায় কীভাবে সংসার চলবে? তিনি বলেন, একজন মানুষ কারও অধীনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করলে হোটেলের খাবার বিল ১৫০ টাকা দেবেন না? তিনি বলেন, একতা পরিবহনের নিয়মে খাবার বিল আছে। এ ছাড়া ৩১ জন যাত্রী উঠলে একটি টিকিট, ৪০ যাত্রী উঠলে দুটি এবং এসি গাড়িতে একটি টিকিট চালক ও কর্মচারীদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এই টাকা সবাই ভাগ করে নেয়। এগুলো অযৌক্তিক দাবি নয়।
যাত্রী দুর্ভোগ
দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় যাত্রী দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ঢাকায় যাওয়ার টিকিট কাটতে দুপুর সোয়া ১২টায় রাজশাহীর শিরোইল বাস টার্মিনালে আসেন গৃহবধূ মেরিনা বেগম। তিনি বলেন, ঢাকায় যাওয়ার টিকিট নিতে এসে সব কাউন্টার বন্ধ পাচ্ছি। শুধু একতা পরিবহন চালু। সেখানে টিকিট পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সব যাত্রীর চাপ পড়েছে একতায়। গরমে কষ্ট হচ্ছে।
আরেক যাত্রী নাসিম আহমেদ বলেন, কাউন্টারে টিকিট পেলাম না। তবে একটি অ্যাপসে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে একতা পরিবহনের টিকিট কেটেছি।
আরেক যাত্রী ইফতিখার আলম রকি বলেন, দুপুর ১২টার টিকিট ছিল। সেই গাড়ি দুপুর ২টার পর যাচ্ছে। ভোগান্তি হচ্ছে। এই গরমে বসে থাকা কঠিন।
একতা পরিবহনের উত্তরবঙ্গের জেনারেল ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম সুমন বলেন, একতা পরিবহনের ৩২টি বাস এসব রুটে চলছে। যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ। টিকিট দিতে পারছি না। যাত্রীরাও টিকিটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কিন্তু সবগুলো গাড়িতে যে যাত্রী নিত তা শুধু একটি পরিবহন দিয়ে সম্ভব না। তবু আমরা সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, ‘বাস চলাচল বন্ধের বিষয়টি শনিবার জেনেছি। চেষ্টা করছি সমাধানের জন্য। দুপক্ষকে নিয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি 



















