নিজস্ব প্রতিবেদক :
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মের নামে ভোট চাওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে যেমন দেশকে বিভাজন করা যাবে না। ইসলামের নামে দেশকে বিভাজন করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ আমার এবং জুলাইও আমার।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় আগ্রাসনবিরোধী যাত্রা শেষে শাহবাগের সমাবেশে একথা বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫৪ বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সুরাহা করতে পারি নাই।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাধ্যমে মুজিববাদ দিয়ে বাংলাদেশকে বিভাজিত করে রেখেছিল। আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্র কায়েম করার বারবার চেষ্টা করেছে। আমরা ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের বয়ান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বের করে নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠা করেছি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনকারী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, পুলিশ-প্রশাসন যদি ব্যর্থ হয়, আমরা আমাদের পাল্টা আঘাত চালিয়ে যাব।
নাহিদ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় ঠিক করে এগিয়ে যেতে হবে। শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে সহজভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি গণঅভ্যুত্থানের ওপর সরাসরি আঘাত। আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ ছাড়া আমাদের আর কোনো নিরাপত্তা বাহিনী নেই। পুলিশ-প্রশাসন যদি ব্যর্থ হয়, আমরা আমাদের পাল্টা আঘাত চালিয়ে যাব। তবে আমরা এখনো সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাই। আমরা চাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক। অতিদ্রুত শরিফ ওসমান হাদির হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করুন।
তিনি বলেন, জনগণের কাছে আমাদের আহ্বান প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লা ও প্রত্যেক পাড়ায় আধিপত্যবাদবিরোধী, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিবিরোধী কমিটি গড়ে তুলুন। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকুন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কোনো পুলিশ-প্রশাসন ছিল না, কিন্তু আপনারা-আমরা মিলেই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছিলাম। আমরা আমাদের দেশের হিন্দুদের রক্ষা করেছি, মুসলমানদের রক্ষা করেছি, শিশু-তরুণদের রক্ষা করেছি। যারা বাংলাদেশকে আঘাত করতে চায়, তাদের আমরা ঐক্যের শক্তি দিয়ে প্রতিহত করব।
নাহিদ বলেন, আমাদের দ্বিতীয় কর্তব্য হলো নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করা। বাংলাদেশে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চলছে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ চাই, সংস্কারের জোয়ার আনতে চাই। যারা এনসিপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের পাশাপাশি বাকি আসনগুলোতেও দ্রুত মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমরা আগামীকাল থেকেই মাঠে নামব। শরিফ ওসমান হাদির আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে ধারণ করে জনগণের কাছে যাব। সংস্কারের পক্ষে আমরা নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে শোনাব।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধান মেনেই আপনারা রাস্তায় নামুন, নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করুন। ওসমান হাদিকে গুলি করা হলেও হাজার হাজার হাদি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণের দরজায় যাবে। নির্বাচন প্রতিহত করার যত চেষ্টা করা হোক না কেন, আমরা সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচনের দিকেই এগোব।
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ করে যদি মনে করা হয় জুলাই যোদ্ধাদের ভয় দেখালে তারা রাস্তায় নামবে না, তারা নির্বাচনী কাজ করবে না, তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে, আমরা কাউকে ভয় পাই না।
তিনি বলেন, শরিফ ওসমান হাদি একটি রিকশা বা ভ্যান নিয়ে, মুড়ি ও বাতাসা নিয়ে পাঁচজন সহযোদ্ধাসহ একাই মানুষের কাছে যেতেন। মসজিদে মসজিদে লিফলেট দিতেন, নিজের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির কথা বলতেন। আমরাও ঠিক এভাবেই পাঁচ-দশ কিংবা বিশজন মানুষ নিয়ে লিফলেট হাতে জনগণের কাছে যাব। আসন্ন নির্বাচনে গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে জনমত তৈরি করব।
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মের নামে ভোট চাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। এখানে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা যারা ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে। তারা ছাড়া বাকি সব দল, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি বাংলাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করেই রাজনীতি করে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের নামে দেশকে বিভাজন করা যাবে না, তেমনি ইসলামের নামেও দেশকে বিভাজন করা যাবে না। গত ৫৪ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর যে রাজনীতি হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ব। ইসলামও আমার, মুক্তিযুদ্ধও আমার, জুলাইও আমার। এগুলো একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা এগুলোকে বিভক্ত করতে চায়, তারাই জাতিকে বিভক্ত করতে চায়।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তরুণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নের চূড়ান্ত সুরাহা করতে পারিনি। এখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনীতি দেখি। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের রাজনীতির সুরাহা হবে। সেই রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে দূর হবে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আমরা দেখছি এই রাজনীতি আবার বাংলাদেশে ফেরত এসেছে যে রাজনীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এবং মুজিববাদী বামরা বাংলাদেশকে বিভাজিত করে রেখেছিল।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। আমরা মনে করি, ১৯৪৭ এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষ আজাদির জন্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছিল, তার অন্যতম পরিণতি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছিলাম, কিন্তু সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে একটি তাবেদারি সরকার কায়েম করার চেষ্টা করেছে।
নাহিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা আমরা ধারণ করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কোন আকাঙ্ক্ষা? মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা? নাকি ১৯৭২ সালে মুজিববাদের আকাঙ্ক্ষা? মুক্তিযুদ্ধের নামে যদি মুজিববাদের চার নীতির আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা আমরা কঠোরভাবে প্রত্যাঘাত করব।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছিল, যা ছিল মুজিববাদী আকাঙ্ক্ষা, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তরুণরা গণঅভ্যুত্থান করেছিলাম। ফলে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা সেটিকে আমরা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট বয়ান থেকে বের করে নতুনভাবে বাংলাদেশের ৫ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করেছি।
সাতচল্লিশ সালের আজাদির লড়াই, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ছিল, সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা। বাংলাদেশে আমরা সে লড়াই শুরু করেছি। এই লড়াই অব্যাহত থাকবে। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর আগ্রাসনবিরোধী কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। মেজর জলিল-ভাসানীরা সেই লড়াই শুরু করেছিলেন, আমরা সে লড়াইকে ধারণ করি। আজকে আমরা জাতীয় পাঁচ নেতার ছবিকে জাতির সামনে রেখেছি। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের এই স্থপতিরা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতি করেছিলেন, এনসিপি সেই আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে এগিয়ে যাবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 






















