প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করোনা পজেটিভ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে প্রকাশিত হোয়াইট হাউজের রিপোর্টার তারা ম্যাকেলভি ‘ট্রাম্প এন্ড দ্য ভাইরাস: এ ডে অব টারময়েল ইন দ্য হোয়াইট হাউজ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন লিখেছেন।
তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, মাসের পর মাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা নিয়মিত মাস্ক ছাড়া ঘুরেছেন। মাঝে মাঝে এমন আচরণ করেছেন, যেন কোনো মহামারীই নেই। এরপরই প্রেসিডেন্টের করোনা শনাক্ত হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব যেন পাল্টে গেছে। এটা যেন এক ভূমিকম্পময় দিনের কাহিনী।
তিনি লিখেছেন- শুক্রবার সন্ধ্যার শুরু। হোয়াইট হাউজ থেকে ৯ মাইল (১৪ কিলোমিটার) দূরে ওয়াল্টার রিড ন্যাশনাল মিলিটারি মেডিকেল সেন্টার ছিল খুব শান্তিপূর্ণ। এতটাই নীরব ছিল যে ওক গাছের একটি ফল একর্ন পতনের শব্দও শোনা যেতো।
কিন্তু অকস্মাৎ সেই দৃশ্য উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে। একটি গাছ থেকে বাস্কেটবলের হুপ পর্যন্ত টেপ টানিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এটা দিয়ে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ান অবতরণের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে বিস্ফোরক সন্ধান করা হয়েছে কুকুর দিয়ে। এসব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল এ জন্য যে, অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হবেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে তা কেউই জানতেন না। প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার অবতরণের সময় সহকর্মীরা কোথায় কোথায় অবস্থান করবেন তা জানিয়ে দিচ্ছিলেন এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বললেন, মনে হয় না কি ঘটতে যাচ্ছে তা কেউ জানেন।
এটা হলো শুক্রবার সন্ধ্যায় হাসপাতালের বাইরের প্রকৃত পর্যবেক্ষণ। হোয়াইট হাউজের চিত্রও অনেকটা একই রকম। অনিশ্চয়তা আসলে শুরু হয় দিনের একেবারে শুরুতে, ওয়াশিংটনের সময় রাত একটার কিছুটা আগে। এ সময় প্রেসিডেন্ট টুইটারে জানান দেন তার করোনা পজেটিভ। সৃষ্টি হয় এক বিশৃংখল অবস্থা। তার মাঝেই হোয়াইট হাউজের সহযোগী ও স্টাফরা তাদের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকেন।
কিন্তু তাদের যে মুড বা ভাবভঙ্গি তাতে মনে হয়, বড় এক বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চারদিকে তখন উদ্বেগ। চিৎকার। কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছেন। প্রেসিডেন্ট দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সঙ্কট নিয়ে একটি আশাবাদী ধারণা তৈরির করেছিলেন, যাতে তিনি করোনাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেই করোনায় মারা গেছেন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে।
সাংবাদিক তারা ম্যাকেলভি আরো লিখেছেন, একটি দাতব্য সংস্থার এক ইভেন্টের জন্য বৃহস্পতিবার আগে থেকে রেকর্ড করা বক্তব্যে ট্রাম্প বলেছেন, করোনা মহামারীর বিদায় এখন দৃশ্যমান। এরই মধ্যে এ সপ্তাহের শুরুতে প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে তিনি ডেমোক্রেট দলের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে সব সময় মাস্ক পরা নিয়ে উপহাস করেন।
আরও পড়ুন : কি আছে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের ভিতরে?
প্রেসিডেন্ট যে দাবি করেছেন এবং তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে অনেক মার্কিনি বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে তিনি আবেদন তুলেছেন তার মূল সমর্থকদের উদ্দেশে। তারা হলেন রক্ষণশীল নারী ও পুরুষ। এর বেশির ভাগই শ্বেতাঙ্গ। এরা ওয়াশিংটন ও অন্যান্য শহরে ডেমোক্রেট বিরোধী।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভাইরাস নিয়ে গত কয়েক মাসে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তার সহযোগী ও স্টাফরা তাদের ভাষায় ও কাজেকর্মে তা আরো বাড়িয়ে বলেছেন। তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে করোনা ভাইরাস সময়ের পূর্ববর্তী অবস্থায় আছেন। ওয়েস্ট উইং অফিসে তাদের হাতেগোনা কয়েকজন মুখে মাস্ক পরেছেন।
আইজেনহাওয়ার এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিংয়ে একটি ছোট্ট লাঞ্চটেবিলে তারা সবাই গাদাগাদি করে একত্রিত হয়েছেন। বিভিন্ন ইভেন্টে হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ লনে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শত শত অতিথিকে।
প্রশাসন শুধু ওইসব ব্যক্তির করোনা স্ক্রিনিং করিয়েছে, যারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংস্পর্শে গিয়েছেন। কিন্তু অতো দ্রুত পরীক্ষার ওপর নির্ভর করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বিষয়ক একটি মিথ্যা ধারণা দেয়া হয়েছে।
এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আক্রান্ত। তার সহযোগীরা এই ভাইরাসের বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। কারণ, এই ভাইরাস এখন তাদেরকে ঘিরে। তাদের অফিসে আগ্রাসন চালিয়েছে। প্রেসিডেন্টের শীর্ষ উপদেষ্টা হোপ হিকসের করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। প্রচারণা বিষয়ক ম্যানেজার বিল স্টেপিয়েন, দু’জন রিপাবলিকান সিনেটর, রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারওমেন রোনা ম্যাকডানিয়েলের করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে।
হোয়াইট হাউজের সিনিয়র স্টাফরা এখন আইসোলেশনে। প্রেসিডেন্টের হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টি দুর্ঘটনাক্রমে ফাঁস হয়ে যায়। এ বিষয়টি কেউ একজন পড়ার আগেই ইমেইল করেছিলেন। এমন এক সংশয়ের মধ্যে, হোয়াইট হাউজের সহযোগীরা মুখে সাহসী ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ল্যারি কুদলো নিশ্চিত করে সাংবাদিকদেরকে শুক্রবার সকালে বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট কঠোর কাজ করছিলেন। প্রচুর ভাল অর্থনৈতিক খবর আছে।
এর বাইরে কুদলো আরো বলেছেন, বিশ্ব নেতাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই প্রথম কোনো করোনায় আক্রান্ত বিশ্ব নেতা নন। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোরানোরও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছিল। কুদলো বলেন, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। তিনি খুব খারাপ সময় পাড় করেছেন। খুবই খারাপ সময়। আমি আশা করি এবং প্রার্থনা করি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যেন তেমনটা না ঘটে।
সাংবাদিক তারা ম্যাকেলভি আরো লিখেছেন, ট্রাম্পের প্রেস সেক্রেটারি কাইলি ম্যাকইনানি বলেছেন, মসৃণভাবে কাজ চলছে হোয়াইট হাউজে। সব কাজের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। তার হালকা লক্ষণ দেখা দিয়েছে। কিন্তু তিনি কঠোর কাজ করছেন। আমরা তার কাজকে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, ফোনে সিনেটর মিশ ম্যাককলেন এবং লিন্ডসে গ্রাহাম সহ সিনেটরদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট।
ওদিকে ওয়েস্ট উইংয়ে লোকজন চিৎকার করছেন। একজন সাংবাদিকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ একজন বলছিলেন, আপনি মাস্ক ছাড়া এখানে প্রবেশ করেছেন। তিনি ওই সাংবাদিককে ওয়েস্ট উইং চত্বর ত্যাগ করতে বলেন। অতিরিক্ত কাজ করে ক্লান্ত শ্রান্ত একজন জুনিয়র স্টাফ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ‘লোয়ার প্রেস’-এ অনিশ্চয়তা। ডেস্কের ওপর কিছু স্যানিটাইজারের বোতল। খবরের কাগজ। একটি বেসবল। একটি চুল বিন্যাসের মেশিন।
তারা ম্যাকেলভি আরো লিখেছেন, ওয়েস্ট উইংয়ে আমরা যারা সময় অতিবাহিত করি, তাদের মাঝে হতাশা দৃশ্যমান বেশ কয়েক মাস ধরে। কারণ, লোয়ার প্রেস অফিসের ডেস্কে যখন সবাই বসেন তখন কারো মুখেই মাস্ক থাকে না। এখন এই রুমে সবাই মাস্ক পরেন। শুক্রবার এখানে যোগ দেয়া সাংবাদিকদেরকে বাড়তি পরীক্ষার কথা বলেছেন কর্মকর্তারা। অন্যরা প্রেসিডেন্টের অবস্থা নিয়ে বাড়তি কিছু জানতে চাইছিলেন।
সিএনএন রিপোর্ট করেছে যে, হোয়াইট হাউজের রিপোর্ট কভার করেন এমন তিনজন সাংবাদিকের শুক্রবার করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। হোয়াইট হাউজে আরো যেসব সাংবাদিক ছিলেন তারাও জানতে চাইছিলেন তাদেরও করোনা পজেটিভ কিনা।
এদিন বিকেলের পরিষ্কার হলো যে, সব কিছু ভাল যাচ্ছে না। তারা ম্যাকেলভি লিখেছেন, একজন স্টাফ আমাকে এবং ছোট্ট এক প্রেস পুলের সদস্যদের বললেন, মিলিটারি হাসপাতালে জড়ো হতে, সেখানে প্রেসিডেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমরা একটি কালো ভ্যানে আরোহন করলাম।
হাসপাতালে পৌঁছার পর ফ্লাশিং লাইট পড়লো। ইমার্জেন্সি প্রবেশ পথের কাছে আমাদের ভ্যানকে থামানো হলো। কিন্তু সেখানে ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পেলাম, প্রেসিডেন্ট যেটাকে বিশ্বের জন্য স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির বলে যাকে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এর স্রষ্টা- তা কতটা ঝুঁকিতে।
মেরিন ওয়ান যখন অবতরণ এলাকায় এসে পৌঁছলো গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতারা বাতাসে উড়ছিল। প্রেসিডেন্ট সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। তবে হাতল ধরে। তিনি তার গাড়িতে উঠলেন। আমি তাকে যতটা দেখলাম, তাতে তাকে বেশ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। এটা ছিল প্রেসিডেন্টের জন্য এবং জাতির জন্যও একটি লম্বা দিনের শেষ সময়।