নিজস্ব প্রতিবেদক :
ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিজয় ঠেকাতে কিছু দল নতুন নতুন শর্ত দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছে, এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ অভিযোগ করেন।
তারেক রহমান বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই নানা বক্তব্য ও শর্ত জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। যারা নতুন নতুন শর্ত দিচ্ছেন, তাদের বলব রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করুন। বিএনপির বিজয় ঠেকাতে গিয়ে জনগণের রায় প্রদানের পথ রুদ্ধ করবেন না।
তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে কোনো কৌশল বা শর্তের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ করা হলে তা দেশের গণতান্ত্রিক স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের বক্তব্য ও শর্ত জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে বিএনপিকে নির্বাচনি মঞ্চে দাঁড়াতে দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের মধ্যেও বিএনপির বিজয় ঠেকানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তিনি দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে তাদেরকে জনগণের মুখোমুখি হতে হবে, জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।
তিনি প্রস্তাবিত প্রতিনিধিত্বমূলক পিআর ভোট পদ্ধতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন উপযুক্ত নয়। কারণ এতে কোনো ব্যক্তি বা দল নির্বাচিত হচ্ছে, তা জনগণ জানার সুযোগ পায় না।
‘বিএনপির বিজয় ঠেকানোর অপরাজনীতি করতে গিয়ে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী সরকার দেশকে একটি তাঁবেদারী রাষ্ট্রে, একটি বিশাল বড় জেলখানায় পরিণত করেছিল। বর্তমানে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশেও যারা মনে করছেন, নির্বাচন দিলে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সহায়তা করবে। যারা এই চিন্তা থেকে বিএনপির বিজয় ঠেকানোর জন্য নানা রকম অপকৌশলের বা শর্তের বেড়াজালের আশ্রয় নিচ্ছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করুন। জনগণের শক্তির ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখুন। বিএনপির বিজয় যদি জনগণ দিয়েই থাকে, সেই বিজয় ঠেকাতে গিয়ে জনগণের রায় প্রদানের পথরুদ্ধ করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। আমিও এর আগে সংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরেছি। আজ আবারো সংক্ষেপে আপনাদের সামনে কিছু কথা দুই একটি কথা এ ব্যাপারে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা জানি, বিশ্বের অনেক দেশেই হয়তো নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য এখনো উপযোগী নয় বলেই আমরা কম-বেশি মনে করি। কাকে কিংবা কোন ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানো হচ্ছে, অবশ্যই জনগণের সেটি জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা হচ্ছে, জনগণের সেটি জানার পরিষ্কার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি বা যেকোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি জাতীয় সংসদে কিংবা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। অবশ্যই তাদেরকে জনগণের মুখোমুখী হয়ে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে জনগণের রায় অর্জন করা জরুরি।’
তারেক রহমান বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি এবং আরো দুয়েকটি ইস্যুতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। এ ধরনের ভিন্নমত এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে বাস্তবতার নিরিখে প্রতিটি ইস্যুই সময়ের সাথে সাথে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে যাবে বা সমাধান করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ইনশাআল্লাহ। যারা আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিস্থিতি ঘোলেটে করার অপচেষ্টা করছেন, এর মাধ্যমে আপনারা হয়তো নিজেদের অজান্তেই গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছেন। একইসাথে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার পুনর্বাসনের পথও হয়তোবা সুগম হচ্ছে। যদি আমরা গণতন্ত্র উত্তোরণের পথে শর্তের পর শর্ত আরোপ করতে থাকি।’
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করলে তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্য না থাকলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অবৈধ স্বার্থ লিপ্ত ছিল। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, দেশে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ ঝুঁকিমুক্ত নয়। বর্তমান সরকার পতিত স্বৈরাচারী শাসকের মতো বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দেশের জনগণ যদি তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচিত করে, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকৃতি রোধ করা সম্ভব।’
তারেক রহমান বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু ভিন্নমত থাকলেও তা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাধানযোগ্য।
তিনি রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান, নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে জনগণের আস্থা ও স্বচ্ছতার মূল্য অগ্রাধিকার দিয়ে চলতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চলছে, যা রোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, আজ খুব সুচারুভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। ১৯৭১ সালকে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। অথচ সেই মুক্তিযুদ্ধই আমাদের এনে দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই সত্য ভুলে গেলে চলবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মাধ্যমেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। সেই মহান যুদ্ধে লাখো শহিদের আত্মত্যাগে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন দেশ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে দেশের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছি। সেই আন্দোলনে শহিদ তরুণদের রক্তে আজ আমরা স্বপ্ন দেখছি একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার। এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে থাকবে না বৈষম্য, অন্যায় কিংবা দমন-পীড়ন। থাকবে সাম্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
অনুষ্ঠানে জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস। আমরা বিশ্বাস করি সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। বিএনপি সবসময়ই ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের পক্ষে। আমাদের রাজনীতি কখনো উগ্রবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করবে না। বাংলাদেশে কোনোভাবেই উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, জাতি আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এ সময় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব।’ তিনি সকল সম্প্রদায়কে একত্রিত হয়ে উগ্রবাদ ও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও ধর্ম বিষয়ক সহসম্পাদক অমলেন্দু দাস অপুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বিজন কান্তি সরকার, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ড, প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়ন বিষয়ক সহ-সম্পাদক অপর্ণা রায় দাস, নির্বাহী কমিটির সদস্য রনেশ দত্ত, দেবাশীষ রায় মধু, নিপুণ রায় চৌধুরী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের তপন চন্দ্র মজুমদার, এসএন তরুণ দে, মিল্টন বৈদ্য, পূজা উদযাপন ফ্রন্টের জয়দেব জয়, হিন্দু মহাজোটের সুশান্ত চক্রবর্তী, ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত দেব, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল বারী ড্যানি, জন গোমেজমহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।