নিজস্ব প্রতিবেদক :
রংপুরের পীরগাছার আলাইকুমারী নদের ওপর নির্মিত ব্রিজটি ধসে পড়েছে। এতে মাহিগঞ্জ-পাওটানা রুটে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ভোগে পড়েছে জনসাধারণ। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের খনন কাজ ও পানি ছেড়ে দেওয়ায় ব্রিজটি ধসে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সোমবার (২৯ মে) দুপুরে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। এখন প্রায় দুই কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত করছেন ওই সড়ক ধরে চলাচল করা যাত্রীসাধারণ ও যানবাহনগুলো।
এর আগে রোববার (২৮ মে) রাত ১০টার দিকে পীরগাছার ইটাকুমারী ইউনিয়নের মাহিগঞ্জ-পাওটানা সড়কের দামুর চাকলা বাজার সংলগ্ন ২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের ব্রিজটি ধসে পড়ে। ওই স্থানে দ্রুত ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তাদের অভিযোগ বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন কাজ ও গাফলতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এ ব্যপারে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা তলবের কথা জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বিকল্প উপায়ে যানবাহন চলাচলে উদ্যোগের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ব্রিজ ধসে যাওয়ায় মাহিগঞ্জ-পাওটানা রুটে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। যানবাহন ও যাত্রীদের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ঘুরে যাতায়াত করতে হচ্ছে। স্থানীয়রা কলাগাছের ভেলা তৈরি করে কোনোমতে পারাপার করছে। শিক্ষার্থীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে। ব্রিজের পূর্ব পাশের দামুরচাকলা বাজারেও মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। বিশেষ করে রংপুর-পীরগাছার যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হওয়ায় ওই এলাকার বড় বড় হাটবাজারগুলোতে যেতে পারছেন না লোকজন। দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণের দাবি জানান এলাকাবাসী।
প্রত্যক্ষদর্শী মেহেদী হাসান জানান, ওই নদের পানি একপাশে বেঁধে রেখে অন্যপাশে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খনন কার্যক্রম চালাচ্ছিল। রোববার বিকেলে ওই পানি ছেড়ে দেয়া হলে ব্রিজটি হুমকির মুখে পড়ে। এর মধ্যেই রাত ৯টায় ব্রিজটির পশ্চিমাংশ ধ্বসে নদীতে পড়ে যায়। এ সময় ব্রিজে লোকজন থাকলেও দৌঁড়ে প্রাণে বাঁচে। এছাড়াও ব্রিজটি অনেক পুরোনো থাকায় পিলারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
স্থানীয় দুলাল হোসেন নামের আরেক ব্যক্তি জানান, ব্রিজটি ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে হয়। তখন আমরা কেবল একটু একটু করে বুঝি। তারপরে একবার উপরটা সংস্কার হয়েছিল। নিচটা করা হয় নাই। ফলে আগের ইট ও সিমেন্ট বালুর টেম্পারেচার খেয়ে গেছে। তার ওপর বরেন্দ্র পানি ছেড়ে দেয়ায় স্রোতের কারণে ব্রিজের পারুল অংশের দুই পাট ধ্বসে গেছে। এখন যোগাযোগ নিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় আছি।
এলাকাবাসী ও লাড্ডুর লিডার আকবর হোসেন জানান, ব্রিজটা ভাঙার কারণে আমরা বাজারঘাট করতে পারছি না। ওপাশেই আমাদের বাজার। প্রতিদিন দু’তিন বার বাজার যাই। কিন্তু রোববার থেকে একবারও যেতে পারি নাই। ওপাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজকে আমার বাচ্চাই মাদরাসায় যেতে পারে নাই। বাস চলাচলও বন্ধ আছে। রংপুর-পাওটানা রুটে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সবারই খুব ক্ষতি হয়েছে। ব্রিজটা দ্রুত হলে খুব উপকার হবে। আমরা খুব ভোগান্তিতে পড়েছি।
আরেক স্থানীয় মোমিনের ইটভাটার ম্যানেজার ফরিদ উদ্দিন জানান, আমাদের খুব দুর্ভোগ হয়েছে। কারণ এই রাস্তা দিয়েই আমরা পীরগাছা, পাওটানা, কাউনিয়া, মধুপুরসহ বড় বড় হাটবাজারগুলোতে যাই। আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে যে এই লোকগুলোর আর যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নাই। আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে। ব্রিজটা দ্রুত না হলে আমাদের ভোগান্তি কমবে না।
দামুরচাকলা বাজারের ঘাস ব্যবসায়ী টুকু প্রধান জানান, ব্রিজের পশ্চিম পাশে আমার বাড়ি। এখন আমি পার হতে পারছি না। ঘাস বিক্রি করেই আমি জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু এখন তো লোকজনই বাজারে যেতে পারছে না। আসছে না। ওই কারণে পশ্চিম পাশেই আক্কাস আলীর দোকানের সামনে ঘাস রেখেছি। কিন্তু বেচাবিক্রি হচ্ছে না।
ব্রিজের পশ্চিম পাশের বাড়ি ভ্যানচালক আল আমিন মুনশির। তিনি জানান, কাল থেকেই ভ্যানের যাত্রী হচ্ছে না। কারণ ব্রিজ দিয়ে তো পার হতে পারছি না। এতে আমার খুব অসুবিধা হয়েছে। এই অবস্থা দু’দিন থাকলে আমাকে পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
একই পাশের চায়ের দোকানি আক্কাস আলী জানান, রোববার রাত ৯টা থেকেই আমার দোকানে বেচাবিক্রি কমে গেছে। কারণ বাজার থেকে তো কোনো লোকজন এপাশে আসতে পারছে না। বরং রংপুর থেকে যেসব লোকজন আসছে তাদেরকে শুধু বিকল্প পথ দেখাতেই আমার সারাদিন কেটে গেল। দ্রুত ব্রিজ চালু হওয়ার দরকার।
উপজেলা প্রকৌশল দপ্তর জানান, মাহিগঞ্জ-পাওটানা সড়কের দামুর চাকলা বাজারের পশ্চিম পাশে আলাইকুমারী নদীর উপর ১৯৮২ সালে ২৭ মিটার দৈঘ্য একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সালে তিস্তা সোলার পাওয়ার প্লান্টের সরঞ্জামাদিবহন করা অসংখ্য ভারি ট্রাক ওই ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচলের কারণে ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়াতে ব্রিজের নিচে থাকা পিলারের ইট সিমেন্ট বালু সব নষ্ট হয়ে গেছে। এর ওপর বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ পানি ছেড়ে দেওয়ায় স্রোতের কারণে ব্রিজের একাংশ ধসে গেছে।
সম্প্রতি উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ওই ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে একই স্থানে ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৬ মিটার দীর্ঘ একটি ব্রিজ নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এদিকে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই রোববার রাতে ব্রিজের উপর দিয়ে একটি নৈশ্য কোচ ও একটি ভারি ট্রাক যাওয়ার পর ব্রিজে ফাটল দেখা দেয়। এর ৩০ মিনিট পর একাই ব্রিজটি ধসে পড়ে যায়।
সোমবার দুপুরে পীরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ মাহবুবার রহমান, ইউএনও নাজমুল হক সুমন, ভাইস চেয়ারম্যান আরিফুল হক লিটন, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান, উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম, ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাশার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
ইটাকুমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাশার জানান, ব্রিজটি আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা ছিল। তাই পুনরায় নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা আছে। এরমধ্যেই বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ছেড়ে দেওয়া পানির স্রোতে পিলারের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ধসের ঘটনাটি ঘটেছে। কীভাবে সড়কটি আবার চালু করা যায় সেটা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছি।
উপজেলা চেয়ারম্যান আবু নাছের মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান জানান, ব্রিজটার একটা স্লাব ধসে পড়ায় আমাদের এলাকার ১ থেকে দেড় লাখ মানুষের যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। ব্রিজ এলাকায় বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খাল খনন করছিল। তারা পানি ছেড়ে দেওয়ার পরপরই ব্রিজ ধসে পড়ে। এতে তাদের কোনো গাফিলতি আছে কিনা সেটা দেখার জন্য আমরা এসেছি। তাদের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার পাশাপাশি আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে যানবাহন চলাচললের জন্য কি ব্যবস্থা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনায় বসেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হক প্রধান জানান, আলাইকুমারী খালের ব্রিজটি রোববার রাতে ধসে গেছে। এখানে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটা খাল খননের কার্যক্রম চলছিল। এ অবস্থায় খাল খননের কারণে ব্রিজটি ভাঙলো কিনা সেটি জানতে আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছি। এছাড়াও দ্রুততম সময়ের মধ্যে অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করে যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা চলছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারি প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ব্রিজের নিচ থেকে মাটিকাটা হয়নি। পানির ঢলের কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে।
উল্লেখ্য, ব্রিজটি ১৯৬৫ সালে নির্মাণের পর ১৯৯৩ সালে উপরের অংশ সংস্কার হয়েছিল।