নিজস্ব প্রতিবেদক :
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ৩৪ হাজার ৮৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৭ হাজার ৩৮২ জন নিহত এবং ৫৯ হাজার ৫৯৭ জন আহত হয়েছেন।
রোববার (১০ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া এক পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে আসে। এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মো. জাহাঙ্গীর।
সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছরই সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে এবং দেশের জন্য এটি এক অশনি সংকেত। এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর পেছনে রয়েছে অবকাঠামোগত পরিকল্পনার অভাব, আইন প্রয়োগে শিথিলতা এবং পরিবহন ব্যবস্থার সার্বিক দুর্বলতা। দেশের সড়ক পরিবহন খাতে কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং পরিস্থিতি দিন দিন আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি।
জাহাঙ্গীর বলেন, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থায় বহুস্তরে নৈরাজ্যের মধ্যে রয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল অবকাঠামো, সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব এবং জবাবদিহিতাহীনতার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সব সময়ই বেশি থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চালকদের অবহেলা ও অদক্ষতা, দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর চাপ, সড়কে গতিরোধকহীন দীর্ঘ অংশ, যান্ত্রিক ত্রুটি, পথচারীদের অসচেতনতা এবং আইন অমান্য করার প্রবণতা। এসব মিলিয়ে প্রতিদিনই মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন কিংবা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরি করেছি। এতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি তিন ধাপে করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কারে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তিনটি রূপরেখা প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বলেন, স্বল্পমেয়াদে আমরা জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে পুনর্গঠন, পরিবহন খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কঠোরতা, যানবাহনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ, দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন চূড়ান্তকরণ এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি।
মধ্য মেয়াদে প্রস্তাব রয়েছে- আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সড়ক তদারকি, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন প্রত্যাহার, রাজধানীতে রুট রেশনালাইজেশন করে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বাস সার্ভিস নিশ্চিত করা এবং মোটরসাইকেলের জন্য গতি ও সিসি সীমা নির্ধারণ। আর দীর্ঘমেয়াদে প্রস্তাব করা হয়েছে- রাজধানীতে বহুতল পার্কিং স্টেশন নির্মাণ, ছোট যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু এবং সড়ক, রেল ও নৌ— এই তিন খাত একত্রিত করে অভিন্ন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় গঠন।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে এখনই একটি সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রস্তাবিত রূপরেখার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বাস্তবায়ন করতে পারে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সেই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারবে। রাষ্ট্রের অবহেলা এবং দীর্ঘদিনের অযত্নের কারণে সড়ক খাত আজ ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে, আর এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
তিনি আরও বলেন, নিরাপদ সড়ক কেবল অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং মানুষের আচরণে পরিবর্তন, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধান পাওয়া যেতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সিভিল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সংগঠনটি দাবি জানায়, দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জন মানুষের প্রাণহানি দেশের জন্য একটি জাতীয় সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির এই ধারা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. কামরান উল বাসেত, পরিবহন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ফেরদৌস খান, উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. আরিফ রাইহান, যুগ্ম সম্পাদক ড. জাহিদুল ইসলাম, সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মাহমুদ রিয়াজ, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এক্সপার্ট পরিচালক আমিনুর রহিম ও বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ একরাম হোসেন প্রমুখ।