চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি :
চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড আখ্যায়িত করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নেপাল-ভুটান, সেভেন সিস্টার্সেরও হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর।
বুধবার (১৪ মে) চট্টগ্রাম সফরের শুরুতেই নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা জানান। সেখানে তাকে বন্দরের সক্ষমতা সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা (চট্টগ্রাম বন্দর) শুধু বাংলাদেশের জন্য না, আশেপাশের দেশের জন্যও। যে কারণে নেপালের কথা বললাম, ভুটানের কথা বললাম, সেভেন সিস্টার্সের কথাও বললাম। সবার জন্য মৃত্যুঞ্জয়।
তিনি বলেন, নেপালের জন্য হৃৎপণ্ডিই নেই। কাজেই আমাদের হৃৎপিণ্ড দিয়ে এটা জ্বালতে হবে। আমরা তাদের সংযুক্ত করতে চাই। এটা তাদেরও লাভ আমাদেরও লাভ। এই হৃৎপিণ্ডে যদি সংযুক্ত হয় সে লাভোবান হবে আমরাও লাভবান হবো। ভুটান যদি সংযুক্ত হয় তারা লাভবান হবে আমরাও হবো। সেভেন সিস্টার যদি যুক্ত হয় তারাও লাভবান হবে আমরাও হবো। এই হৃৎপিণ্ডকে বাদ দিয়ে চললে, যারা এটাকে বাদ দেবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই হৃৎপিণ্ডকে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এজন্য আমি নেপাল ও ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) কথা বলেছি। যদি তারা এতে যুক্ত হয়, তারা উপকৃত হবে, আমরাও হব। যারা যুক্ত হবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, যদি সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরই আমাদের আশা। এটি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিবর্তনে চট্টগ্রাম বন্দরই মূল ভরসা। এটি বাদ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে নতুন কোনো অধ্যায়ে প্রবেশ করানোর সুযোগ নেই। বন্দরের পথ উন্মুক্ত হলে দেশের অর্থনীতিরও অগ্রগতি হবে। অন্যথায় যতই চেষ্টা করা হোক, অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, হৃৎপিণ্ড যদি দুর্বল হয়, তাহলে শরীর চলতে পারে না। এই হৃদপিণ্ডকে যতই চাপ দেওয়া হোক, রক্ত সঞ্চালন হবে না। বন্দরকে বিশ্বমানের করে তুলতে হবে। তখনই দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসবে। এখান থেকেই বিদেশে পণ্য রপ্তানি হবে এবং বিদেশি পণ্য আমদানি করা যাবে। এটাই বন্দরের মূল কাজ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দুঃখের বিষয় হলো, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তন এতটা শ্লথ কেন? বিশ্বব্যাপী সবকিছু বদলাচ্ছে, অথচ এখানে তেমন অগ্রগতি নেই। এটি আজকের প্রশ্ন নয়। চট্টগ্রামবাসী হিসেবে আমরা দেখছি, বন্দর এলাকায় যানজট, ট্রাকভর্তি রাস্তায় পণ্য খালাসের জটিলতা। এর ফলে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটও মিস হয়ে যায়। এই সমস্যাগুলো নিয়ে অনেকবার আলোচনা ও লেখালেখি করেছি। এখন যখন সুযোগ পেয়েছি, প্রথম দিন থেকেই পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দিয়েছি, যাতে পরিবর্তন নিশ্চিত করা যায়।
বিশ্ব যেখানে এগিয়ে চলেছে, বাংলাদেশ ‘অনেক পিছিয়ে পড়েছে’ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, কেউ গুরুত্ব দেয় না। এজন্য আমি পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছি। আমি বলেছি বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্বের শীর্ষ অপারেটরদের হাতে তুলে দিতে হবে। আশা করি সবাই একদিন বুঝবে।
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নিজের শৈশব স্মৃতির কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, এই সফরের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। চট্টগ্রাম বন্দর আমার জন্য নতুন কিছু নয়। আমি শৈশব থেকেই এর সঙ্গে পরিচিত। এটি অনেক বদলেছে, তবে দুঃখের বিষয় হল পরিবর্তন ধীর গতির। আমি যখন সুযোগ পেলাম, তখন থেকেই ভেবেছি কী করা যায়।
শৈশবে চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে নিজের স্মৃতিচারণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর আমার কাছে নতুন নয়। শৈশব থেকেই এর সঙ্গে পরিচিত। এ বন্দর অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, তবে দুঃখের বিষয়—এ পরিবর্তনের গতি ধীর। আমি যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন থেকেই ভাবছিলাম কী করা যায়।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। কেউ এই বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে ভাবে না। এজন্যই আমি পরিবর্তনের কথা বলেছি। আমি বলেছি, বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হবে। আশা করি সবাই এটি বুঝবে।
চাকরি প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ওরা যে আসছে তারা কি তাদের দেশ থেকে লোকজন নিয়ে আসবে? বন্দর চালাতে হলে আমাদের লোকই চালাবে। এটা থেকে গত্যন্তর নেই। আমাদের লোকদের শিখিয়ে দিলে খুব সহজে শিখে নেবে। খরচ কম। ইউরোপ থেকে শ্রমিক এনে যদি আমাদের বন্দর চালাতে হয় সেই ব্যবসা লাটে উঠবে। বন্দর বড় হবে, ক্যাপাসিটি বড় হবে। প্রযুক্তি সত্ত্বেও আগে যেখানে একজন লোক লাগতো এখন বন্দর বড় হওয়ায় পাঁচজন লাগবে। আমি বলি, আজ সই করে দিলেও পাঁচ বছর লাগবে বন্দর হিসেবে পরিচালনা করতে। ধরলাম ২০৩০-৩১। সত্যিকার ফুল স্পিডে কাজ শুরু হবে পাঁচ বছর পর। আমাদের লোকজন এর মধ্যে অভিজ্ঞ হবে। ক্রমে তাদের ওপর ভরসা করবে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ২০৩১ সালে তারা কর্মক্ষম হয়ে যায়, সব কিছু চালু হয়ে যায় ২০৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর তারা চালায় এসব টপ কোম্পানি তাদের বহু জায়গাতে বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে। তাড়াতাড়ি বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের লোকদের। দেখবে যে বন্দরে পা দাও দেখবে পরিচালনা করছে বাংলাদেশি। কোথা থেকে এসেছে? চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। চাকরি কমবে নাকি চাকরি বাড়বে। আমরা বুঝতে চাই না কেন। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে এটা করবে। আমাকে দরখাস্ত নিয়ে ঘুরতে হবে না। যারা ভালো কাজ করবে পরিবারসহ নিয়ে যাবে। যে জায়গা খালি হবে সেখানে আরেক বাংলাদেশি চাকরি পাবে। কাজেই বিরাট একটা সুযোগ আমাদের।
তিনি বলেন, একসময় দেখা যাবে যে বন্দরেই পা দাও পরিচালনায় সব বাংলাদেশি, চাটগাঁইয়া, নোয়াখাইল্যা, বরিশাইল্যা। সব আমাদের দেশি। আমাদের সেই ক্ষমতা আছে। অবজ্ঞা করে, পাশ কাটিয়ে চলে গেলে আমাদের কপালে দুঃখ দিলাম। সবার কাছে অনুরোধ, বন্দর চেয়ারম্যানের পাশে আমরা দাঁড়াই। আমাদের বলেন, আপনি কী করতে চান। আমরা তার দলে শরিক হলাম। এ চট্টগ্রাম বন্দর দেশসেরা বন্দর হিসেবে রাখবো এ জন্য কারণ এটি সেরা না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সেরা হবে না। এ কথাটা আমাদের বুঝতে হবে এবং তড়িৎ সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে। ২০৩৬ সালের কথা বললাম, যেখানে বাংলাদেশিরাই পৃথিবীর বন্দরগুলো চালাবে। সেই দিনের আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমরা দ্রুত চুক্তিগুলো সই করে ফেলতে পারি। কাজগুলো শুরু করতে পারি। অনেক দিন গত হয়ে গেছে। আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই আমাদের। যত দিন অপেক্ষা করবো আমাদের এ বন্দরে এত চাপ পড়বে একদিন কলাপস করে যাবে। সহ্য করতে পারবে না। তার চেয়ে এ অবস্থাতেই আমরা ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দিই। তারা আমাদের বানিয়ে দেখাক। আমরা তাদের কাছ থেকে কাজগুলো শিখে নিই বুঝে নিই। যাতে যেটুকু পেয়েছি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভালো করতে পারি। যাতে বন্দর ব্যবসাতে বাংলাদেশিদের কথা সবাই সব জায়গাতে স্মরণ করে তারা জানে বন্দর কীভাবে ম্যানেজ করতে হয়। সেই গোপন রহস্য আমরা উদ্ধার করে ফেলতে পারি, বন্দর কীভাবে চালাতে হয়।
নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে প্রধান উপদেষ্টার আগ্রহের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে কয়েকটি নতুন টার্মিনাল নির্মিত হলে কনটেইনার জট অনেকটা কমে যাবে। আমি আশা করি, ছয় মাসের মধ্যেই আপনারা এর পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বন্দরের আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এই বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয় এবং তার ৯৮ শতাংশই নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে এই বন্দরের কোনো কার্যকর বিকল্প নেই। তবে প্রাকৃতিক কারণে ২০০ মিটারের বেশি দীর্ঘ জাহাজ এই বন্দরে নোঙর করতে পারে না। এর ফলে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়—যা বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।