নিজস্ব প্রতিবেদক :
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন যে অবাধ-সুষ্ঠু হতে পারে, তা প্রমাণ হয়েছে। আপনাদের (বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক) আগমনের কারণে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার আরও সুরক্ষিত হয়েছে। আপনারা যার যার দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের কথা বলবেন। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। আবহাওয়াও অনেক ভালো। আপনাদের আগমন আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করবে, শক্তিশালী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) বিকেলে গণভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন
তিনি বলেন, আমাদের দল জনগণের দল, এবারে নির্বাচনে জনগণ যে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে এবং আমাদের অনেক স্বতন্ত্রও নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদলগুলোরও বেশকিছু নির্বাচিত হয়েছেন। এ দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়েছি। এ বিজয়টা হচ্ছে জনগণের বিজয়। এ বিজয়টা আমার বিজয় নয়। আমি মনে করি জনগণের বিজয়। কারণ এখানে জনগণের যে অধিকার আছে, সরকার গঠন করার ক্ষমতা আছে তাদের হাতে। যেটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি; জনগণের ভোটের অধিকার, সেটা তারা নিজেরা প্রয়োগ করবে সেটা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আটবার নির্বাচন করেছি।, এবার আবার। এবার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। বাবা যে আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন, আমাকে সেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালে যারা নারী ধর্ষণ করেছিল, লুটপাট করেছিল,অগ্নিসংযোগ করেছিল, স্বাধীনতার পরপর তাদের বিচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতায় এসে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসায়। যখন আমার মা-বাবার খুনিরা এবং যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায়, ওই অবস্থায় আমি দেশে ফিরে আসি। আমার আসার একটাই লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা; মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা; গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আর্থসমাজিক উন্নতি করা।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। আমার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছোট বোন শেখ রেহানা আর আমি বেঁচে যাই। ছয় বছর আমরা রিফিউজি ছিলাম। খুব কষ্টকর জীবন। ১৯৮১ সালে দেশের মানুষ আমাকে দেশে আনে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিলিটারি ডিক্টেটররা আমার দলকে রাজনীতি করতে দেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে তাদের ক্ষমতায় বসায়। ওই অবস্থায় আমি দেশে ফিরি। আমার লক্ষ্য ছিল, মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমার চলার পথ সহজ ছিল না। মৃত্যুকে বারবার কাছ থেকে দেখেছি। বাবার আদর্শ নিয়ে কাজ করছি। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছি। ২১ বছর পর সরকার গঠন করে মানুষের জন্য কাজ শুরু করি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাই আমার লক্ষ্য। এবারের নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী মনোনয়ন করার পাশাপাশি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন। এ বিজয় জনগণের বিজয়।
তিনি বলেন, একটি দল নির্বাচন বর্জন করেছে। মিলিটারি ডিক্টেটর থেকে যে দল সৃষ্টি তারা নির্বাচন ভয় পায়, কারণ তাদের জনসমর্থন থাকে না।
এ সময় দেশি বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি আমাদের দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এটা অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা। আমি অনেকবারই নির্বাচন করেছি। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে আটবারই আমার নির্বাচন করা হয়ে গেছে। তবে এত মানুষের আগ্রহ আগে দেখিনি।
২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সবসময় এটাই চেষ্টা ছিল নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করা, মানুষের যে ভোটের অধিকারটা সেটা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ মানুষ যাতে তার পছন্দের প্রার্থীকে বেচে নিতে পারে সে জন্য নির্বাচনের সিস্টেমকে সংস্কার করেছি।
তিনি বলেন, নির্বাচন চলাকালীন সময়ে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সকলেই নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ থেকে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করেছে। এবারের নির্বাচনটা আরেকটু ব্যতিক্রমী। সাধারণত আমরা দলকে প্রার্থী ঠিক করে বা সব দলগুলো তাদের প্রার্থী নির্বাচন করে দেয়। এবার আমরা আমাদের প্রার্থী নির্বাচিত করেছি, পাশাপাশি এ নির্বাচনটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। যে যার ইচ্ছামতো দাঁড়াতে পারবে। আপনারা দেখেছেন একটি দল হয়ত অংশগ্রহণ করেনি। কারণ তারা কখনোই নির্বাচন করতে চায় না। সে দল মিলিটারি ডিক্টেটরের হাতে তৈরি। ফলে তারা নিজেরা চলতে পারে না, নিজেদের জনসমর্থন থাকে না। সেই জন্য নির্বাচনকে ভয় পায়।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন হয়ে গেছে, এখনো গেজেট হয়নি। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সম্পূর্ণ ফলাফল আসলে গেজেট হবে তখনই শপথ হবে। এরপর আমাদের সংসদীয় দলের বৈঠক করতে হবে। সেখানে সংসদীয় দলের নেতা কে হবে সেটা নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সেটা নির্বাচিত করবেন। মেজরটি পার্টি যাকে নির্বাচিত করবেন তিনিই হবেন সংসদীয় দলের নেতা, তখন সরকার গঠন করতে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হবে, সরকার গঠন হবে। এটাই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, সেই অনুযায়ী করতে চাচ্ছি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর কাছ থেকে বরাবরই আমরা সহযোগিতা পেয়ে আসছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
ড. ইউনূসের সাজা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, শ্রম আইনের মামলায় ড. ইউনূসের সাজা হয়েছে। নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এখানে সরকারের করার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দিক থেকে কোন সমস্যা নাই। সম্পর্কের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর নির্ভর করছে। আমি প্রতিশোধপরায়ণ না। কারো প্রতি আমি প্রতিশোধ নেই না।
শেখ হাসিনা বলেছেন, আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা সন্ত্রাসী দল বিএনপিকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কারণ মানুষ তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাড়া দেয়নি। এদেশের জনগণ নিজেদের ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকারের ব্যাপারে এখন অনেক বেশি সচেতন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিবিসির এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। তবে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ– সরকার দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার পথ সীমিত করেছে। বাংলাদেশে গতিশীল গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকবে কি না?
শেখ হাসিনা জবাবে বলেন, যেকোনো বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রত্যেকটা রাজনৈকিত দলের অধিকার। যদি কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নেয়, তার মানে এই না সেদেশে গণতন্ত্র নেই, দেখতে হবে নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করেছে কি না।
বিএনপিকে উদ্দেশ করে সরকারপ্রধান পাল্টা প্রশ্ন রাখেন তারা কী করেছে? অগ্নিসংযোগ করছে, মানুষ পুড়িয়ে মারছে। কিছুদিন আগেও ট্রেনে আগুন দিয়ে মায়ের কোলের শিশুসহ চারজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। এটা কী গণতন্ত্র?
তিনি আরও বলেন, হ্যাঁ, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু, যখন কেউ সাধারণ মানুষকে হত্যা করছেৃ এটা কী রাজনীতি? এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এদেশের মাটিতে কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না। জনগণ কখনও তা মেনে নেবে না। একবার না, এদেশে মাটিতে তারা বহুবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।
সরকারের অবস্থান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জনগণের অধিকার নিশ্চিত করেছি। তারা (বিএনপি) ভোটারদের বাধা দিয়েছে যাতে তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে, ভোট দিতে না পারে। কিন্তু জনগণ সাড়া দেয়নি। কারণ এদেশের মানুষ এখন তাদের ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। যদি এখানে গণতন্ত্রের অন্য কোনো সংজ্ঞায়ন থাকে সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু আমরা জনগণের অধিকারে বিশ্বাসী।
বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, তারা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য সর্বোচ্চ দিয়ে অপচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তারা সফল হয়নি। কতগুলো মানুষকে হত্যা করেছেৃএটা শুধু এবার না। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে তারা একই কর্মকাণ্ড করেছিল– অগ্নিসংযোগ করে ৩ হাজারের বেশি মানুষকে দগ্ধ করেছে, ৫০০ মানুষকে হত্যা করেছে।
সাংবাদিকের প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন ‘আপনি তাহলে তাদের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে কীভাবে সংজ্ঞায়ন করবেন? তারা সন্ত্রাসী দল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি খুবই সাধারণ মানুষ। মনে করি, এটা মানুষকে সহায়তার একটা সুযোগ। তাই পরবর্তী পাঁচ বছর হবে অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে আরেকটু ভালো রাখার জন্য।
মার্কিন পর্যবেক্ষকের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে। তবে আমাদের দিক থেকে তো কোনো সমস্যা নেই। আপনার কী মনে হয় না যে, এই নির্বাচন আপনাদের দেশের চেয়ে ভালো হয়েছে। আমি কারও ওপর কখনো প্রতিশোধ নেই না।
বাংলাদেশকে স্মার্ট বানানোর লক্ষ্যে কাজ করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ্যটাই হলো ২০৪১ সাল, স্মার্ট একটা দেশ তৈরি করা। যেখানে সমৃদ্ধ দেশে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। সরকার গঠনের পর স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আরও উন্নয়ন কাজ করা হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোও আমাদের সহায়তা করে যাচ্ছে।
এসময় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ে দলের সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি। ঢাকার সঙ্গে দেশগুলো সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। এছাড়া, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অভিনন্দন জানিয়েছেন। সাক্ষাৎ করেছেন বিজয়ী প্রার্থীরাও।