সিলেট জেলা প্রতিনিধি :
সিলেট নগরীর বাসিন্দাদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা। অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী, রোগী থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কোনো না কোনোভাবে নির্ভর করতে হয় এই যানটির ওপর। কাগজে-কলমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ‘প্রাইভেট যান’ হলেও বাস্তবে এটি সিলেট নগরবাসীর একমাত্র ‘গণপরিবহন’ হিসেবে চলাচল করছে।
নির্দিষ্ট ভাড়া নির্ধারণ না করায় চালকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকেন, যা নিয়ে প্রায়ই যাত্রী-চালক বাগবিতণ্ডা হয়। অনেক সময় চালকদের রোষানলে পড়তে হয় যাত্রীদের। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন নগরবাসী। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কাজটি করা হয়নি।
অবশেষে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)। তবে এটা নিয়ে শঙ্কা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রাইভেট’ যান হিসেবে। এতে করে নিয়ম মেনে তিনজন যাত্রী বহন করলে অতিরিক্ত ভাড়ার বোঝা উল্টো যাত্রীদের ঘাড়েই পড়বে। আর আগের মতো ‘অনিয়ম’ করে পাঁচজন যাত্রী বহন করলে ভাড়া কিছুটা কমবে। কিন্তু চালকরা কোন নিয়মে চলবেন—এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এর আগেও বেশ কয়েকবার অটোরিকশাচালকদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে এসএমপি।
অবশ্য পুলিশ বলছে, অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করার জন্য একটা প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এটি আপাতত পাঁচজন যাত্রী বহনের জন্যই প্রযোজ্য হবে। তবে চালকরা মানবেন কি-না, অথবা যাত্রীরা সন্তুষ্ট কি-না সেটা পর্যবেক্ষণ করা হবে। পরবর্তী সময়ে সব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অধিকতর যাচাই-বাছাই শেষ ভাড়া নির্ধারণ চূড়ান্ত করা হবে।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) রাতে এসএমপির ফেসবুক পেজে প্রস্তাবিত একটি ভাড়ার তালিকা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। এসএমপি কমিশনার আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী সই করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিলেট নগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যাতায়াত করতে সিএনজিচালিত থ্রি হুইলারের ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত ভাড়ার তালিকা প্রস্তুতকরণে নগরের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, সিএনজি মালিক ও শ্রমিক নেতাসহ সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নগরবাসীকেও মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। মতামত পাঠানোর জন্য ই-মেইল ও মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে গণবিজ্ঞপ্তিতে।
প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে চলাচলের জন্য সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। ঘণ্টা ভিত্তিতে ভাড়ার জন্য প্রতিঘণ্টা ১৫০ টাকা ও পরবর্তী প্রতি ৩০ মিনিট ৭৫ টাকা করে প্রস্তাব করা হয়েছে।
বন্দরবাজার, কোর্ট পয়েন্ট থেকে আম্বরখানা, টিলাগড়, এমসি কলেজ, শিবগঞ্জ, হুমায়ূন রশিদ চত্বর, দক্ষিণ সুরমা বাসটার্মিনাল, ওসমানী মেডিকেল, রিকাবীবাজার, মধুশহীদ, ঘাসিটুলা, শেখঘাট, কলাপাড়া ও লামাবাজার পর্যন্ত ৬০ টাকা; পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, সুবিদবাজার, ইসলামপুর, মেজরটিলা বাবনা পয়েন্ট ৭৫ টাকা; আখালিয়া, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমারগাঁও বাসটার্মিনাল ৯০ টাকা; টুকেরবাজার,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গেট, আখালিয়া, কুমারগাঁও বাস টার্মিনাল, শাহপরান (রহ.) মাজার গেট, খাদিম, টুকের বাজার ১২০ টাকা, মাসুক বাজার ১৫০, বিমানবন্দর, ক্যাডেট কলেজ, বড়শলা ১৭৫ এবং বটেশ্বর, পীরের বাজার ১৮০ টাকা।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেটের সম্মুখ থেকে বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট, আম্বরখানা পর্যন্ত ৬০ টাকা, কুমারগাও বাসটার্মিনাল, তেমুখি পয়েন্ট, টুকের বাজার ১০০ টাকা।
আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে বন্দরবাজার পয়েন্ট, সুরমা পয়েন্ট, কোর্ট পয়েন্ট, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, সুবিদবাজার, বন্দরবাজার পর্যন্ত ৬০ টাকা, টিলাগড় এবং এমসি কলেজ, বালুচর, টুকেরবাজার ৭৫ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
বড়শলা, ক্যাডেট কলেজ, কোম্পানীগঞ্জ বাইপাস ৯০ টাকা, শাহপরান (রহ.) মাজার গেট, খাদিম, বিমানবন্দর, বাদাঘাট, সোনাতলা, মইয়ারচর, জালালাবাদ থানা ১২০ টাকা, সালুটিকর ১৫০ টাকা, লামাকাজী ১৮০ টাকা, হুমায়ুন রশিদ চত্বর থেকে ওসমানী মেডিকেল ১২০ টাকা ও কুমারগাঁও বাসটার্মিনাল ১৫০ টাকা।
রেলস্টেশন পর্যন্ত বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, তালতলা, জিতু মিয়া পয়েন্ট, চকের বাজার, নয়াবাজার, সিলাম, মোহম্মদপুর, বলদী আলশপাশ এলাকা পর্যন্ত ৯০ টাকা; ওসমানী মেডিকেল, লামাবাজার, রিকাবীবাজার পর্যন্ত ১২০ টাকা, আম্বরখানা সুবিদবাজার, মাজারগেইট আশপাশ এলাকা ১৫০ টাকা, কুমারগাঁও, টুকেরবাজার ১৮০ টাকা, টুকেরবাজার, তেমুখি থেকে আম্বরখানা, সুবিদবাজার, লামাকাজী, মোঘলাগাঁও, শিবেরবাজার ও পিটারগঞ্জবাজার পর্যন্ত ৯০ টাকা।
মোগলাবাজার থেকে জালালপুর বাজার ৭৫ টাকা, রাখালগঞ্জ বাজার, আনিলগঞ্জ ৯০ টাকা, কিনব্রিজ, কদমতলী, বাসটার্মিনাল, হুমায়ুন রশিদ চত্বরের আশপাশ এলাকায় ১২০ টাকা, খালোমুখ থেকে কিনব্রিজ, কদমতলী, হুমায়ূন রশিদ চত্বর, কদমতলী বাসটার্মিনাল ও রেলস্টেশন পর্যন্ত ৯০ টাকা।
কদমতলী মুক্তিযোদ্ধা পয়েন্ট থেকে গোটাটিকর, পাসপোর্ট অফিস, কুশিঘাট আশপাশ এলাকায় ৬০ টাকা, পাঁচমাইল, সিরাজ উদ্দিন চত্তর পর্যন্ত ৬০ টাকা, হেতিমগঞ্জ (মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে) ১৫০ টাকা, শাহপরাণ মেইন গেট থেকে আম্বরখানা, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, সুরমা পয়েন্ট আশপাশ এলাকায় ১২০ টাকা।
কিনব্রিজ, দক্ষিণপাড় (ভার্থখলা, বাবনা পয়েন্ট) থেকে চন্ডিপুল, দক্ষিণ সুরমা থানায় ৬০ টাকা; জালালপুর, কলাবাগান পর্যন্ত ১২০ টাকা, বিশ্বনাথ (কামাল বাজার হয়ে) ১৮০ টাকা। চন্ডিপুল থেকে জালালপুর বাজার ৭৫ টাকা, বন্দরবাজার, সুরমা পয়েন্ট, জিতুমিয়া পয়েন্ট, তালতলা, সোবহানীঘাট বাজার, উপশহর পয়েন্ট পর্যন্ত ৯০ টাকা, রিকাবীবাজার ও ওসমানী মেডিকেল আশপাশ এলাকায় ১২০ টাকা।
জেল রোড পয়েন্ট থেকে নোয়াগাঁও, সাদীপুর, সাদাটিকর, বুরহানউদ্দিন মাজার, কুশিঘাট পর্যন্ত ৭৫ টাকা, মুক্তিরচক, মীরেরচক/শাহপরাণ (রহ.) থানা গেট, মুরাদপুর বাজার পর্যন্ত ১২০ টাকা।
জালালাবাদ গ্যাস অফিস সংলগ্ন মেন্দিবাগ থেকে শাহজালাল উপশহর, শিবগঞ্জ পর্যন্ত ৫০ টাকা; শাহী ঈদগাহ থেকে আম্বরখানা ৫০ টাকা, জেলরোড পয়েন্ট ৬০ টাকা; বালুচর পয়েন্ট এমসি কলেজ ছাত্রাবাস সংলগ্ন এলাকা থেকে টিলাগড় ৫০ টাকা, আম্বরখানা ৬০ টাকা; জালালাবাদ গ্যাস অফিস সংলগ্ন মেন্দিবাগ থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৮০ টাকা।
এদিকে, ফেসবুকে এসএমপির জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে মো. ফয়সল আহমদে নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, সিএনজি যাত্রী কয়জন বহন করবে? এটা নির্ধারণ জরুরি।
মোহাম্মদ সজিব আহমেদ নামের আরেকজন লিখেছেন, যারা এই ভাড়া ঠিক করেছেন তারা ভাড়া সম্বন্ধে কোনো আইডিয়াই রাখেন না।
সজিবুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, জনগণের মতামত জানতে চেয়েছেন, এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু চার্টটা তো ক্লিয়ার করতে পারতেন। এটা রিজার্ভ ভাড়া কি-না! লোকালি গেলে কতজন করে উঠবে?
এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) সুদীপ্ত রায় বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ‘প্রাইভেট’ যান হলেও সিলেটে এটি ‘গণপরিবহন’ হিসেবে চলাচল করছে। আমরা ভাড়া নির্ধারণের জন্য যে প্রস্তাবনা তৈরি করেছি, সেটি প্রাইভেট হিসেবে হলেও পাঁচজন যাত্রী চলাচলের জন্য প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে ভাড়া অনেকটা কমেছে।
তিনি বলেন, এটি নির্ধারণ করতে সব শ্রেণিপেশার প্রতিনিধির মতামত নেওয়া হয়েছে। এখন চালকরাও সেটা মানার কথা। এজন্য আমরা এটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করেছি। যদি কোনো অভিযোগ না থাকে তাহলে পরবর্তীতে এটি চূড়ান্ত করা হবে। আর যদি অভিযোগ আসে, সেগুলোও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।
সিলেট জেলা প্রতিনিধি 





















