নিজস্ব প্রতিবেদক :
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, দেশের বিচার ব্যবস্থা ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। তরুণদের অংশগ্রহণ এগুলোর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
রোববার (২৭ জুলাই) সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইসিজেআর-১) প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জুলাই বিপ্লবের প্রস্তাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, একাডেমিক ও গবেষণাপত্র উপস্থাপন ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং বাংলাদেশ ২.০ গঠনের দিকনির্দেশনা তৈরি – এ লক্ষ্যে আয়োজিত এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে দেশ ও বিদেশের মোট ১৫টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটি সংগঠন।
আদিলুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে থেকে গেছে। যারা এখনও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের চেতনা মাথায় রেখে তাদের আর ফিরতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক গুম, গণগ্রেফতার, খুন বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের জন্য নিত্য ঘটনা ছিলো। শিক্ষক, ছাত্র, নারী, শিশু কেউই তাদের নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে বাদ যায়নি। জুলাই আন্দোলনে শহীদদের খুনের বিচার হবেই। এ সময় বিচার নিয়ে তরুণদের সরব থাকার আহ্বানও জানান তিনি।
আদিলুর রহমান বলেন, আমরা আজ যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের পতন দেখেছি, সেটার নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেককে সামগ্রিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এই শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল। শুধু তাই নয় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। গুম-খুন হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাদেরকে অপরাধী হিসেবে জেলে ভরা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুক্ত চিন্তায় বাধা দেওয়া হতো।
জুলাই বিপ্লবের প্রথম আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনকে শুধু আলোচনা নয়, বরং একটি সাক্ষ্য প্রমাণের প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিকৃত ইতিহাস থেকে সত্যকে উদ্ধার করতে চাই। যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের পরিবারদের কান্না, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে গেঁথে থাকা গুলির চিহ্ন, এসবই একদিন ন্যায়বিচারের নির্মাণকাজে প্রমাণ হয়ে উঠবে।
আদিলুর রহমান তার বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবারও সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। এর শ্রেণিকক্ষগুলো হয়ে উঠেছিল রণকৌশলের কেন্দ্র, ছাত্ররা হয়ে উঠেছিল বিবেকের যোদ্ধা। আমরা বিদেশি গবেষক, অধ্যাপক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ, যারা বিপজ্জনক সময়েও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
বক্তব্যের শেষে তিনি এই সম্মেলনকে একটি জাতীয় অঙ্গীকারে পরিণত করতে জুলাই বিপ্লবের দলিলপত্র, ভিডিও, ফটো নিয়ে একটি আর্কাইভ গড়ে তোলা, স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে জুলাই ইতিহাস সত্যনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অংশে ইন্ডিয়ান হেজিমোনি অ্যান্ড জুলাই রেভ্যুলেশন ২০২৪ শিরোনামে কী-নোট বক্তব্য প্রদান করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কোনো দানশীলতা নয়, বরং সূক্ষ্ম একটি ভূ-রাজনৈতিক হিসাব ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ভারত ভেবেছিল পাকিস্তান ভেঙে গেলে বাংলাদেশ ভারতের অনুগত হবে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলিম, যারা কখনোই হিন্দু-প্রধান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশে ইসলামী পরিচয়ের পুনরুত্থান ঘটে।
এসময় তিনি বলেন, ভারত নিজে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন করে। কারণ তারা মনে করেছিল যে শেখ হাসিনার মাধ্যমেই তাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটে ভারতের সমর্থনই এই প্রমাণ করে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের এক অনন্য সংমিশ্রণ যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এই বিপ্লব শুধু আমাদের দেশেই নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।
বক্তব্য প্রদানকালে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ জন এফ. ডেনিলোইজ বলেন, জুলাই বিপ্লব কোনো বিদেশি শক্তি বা গভীর রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংগ্রামের ফসল। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কাছে প্রমাণ দেওয়া কঠিন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত ছিল না। আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনো প্রমাণ দেখিনি। যদি এমন কোনো প্রমাণ কারো কাছে থাকে আমি সেটা দেখাতে চ্যালেঞ্জ করছি। তিনি আরো বলেন, বিপ্লব সফল হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অস্থিতিশীলতার পরিবেশ ও তথ্য যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে যা এখনও চলমান রয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এসময় আমেরিকার প্রশাসন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে তা উল্লেখ করে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে সরকারের দায়িত্বে যারা আসবেন তাদেরকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে উল্লেখ করে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের যথার্থ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ২৪-এর জুলাই বিপ্লব কেবল একটি প্রতিবাদ ছিল না, এটি ছিল জাতীয় জাগরণ। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৪০০টি প্রবন্ধ জমা পড়ে। এরমধ্যে ৬০টি প্রবন্ধ মৌখিক উপস্থাপনের জন্য ৬০টি পোস্টারকে মনোনীত করা হয়েছে।
সম্মেলন শেষে টিএসসি অডিটোরিয়ামে ‘লাল জুলাই’ নামক একটি মঞ্চ নাটক পরিবেশন করা হবে।