নিজস্ব প্রতিবেদক :
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সিন্ডিকেট ভাঙা, সারাদেশে রেশনব্যবস্থা, ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুসহ উৎপাদক ও ক্রেতা সমবায় গড়ে তোলার দাবিতে আগামী ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাজারে গেলে মানুষ এখন আর হাসিমুখে ঘরে ফিরতে পারেন না। প্রতি মুহূর্তে তিনি টের পাচ্ছেন যে, তার টাকার দাম কমে গেছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সে হারে আয় বাড়েনি। ফলে বাজেট থেকে প্রথমে শখের পণ্য, পরে প্রয়োজনীয় পণ্য ছেঁটে ফেলে কাম-ক্লেশে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অথচ অন্যদিকে এই করোনাকালেই কোনো কোনো লোকের আয় অত্যন্ত দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
তারা বলেন, ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের পরিসংখ্যান অনুসারে বিলিওনেয়ার ক্লাবে এক বছরেই নতুন করে বাংলাদেশের ২৬ জন যোগ দিয়েছেন। বি.আই.ডি.এস এবং সানেমের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা নেমে গিয়েছিলেন তারা এখন পর্যন্ত সবাই দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে পারেননি। আমরা তাই আবার ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যের হারের মধ্যেই আছি। সরকারের কমিয়ে দেওয়া ২০ শতাংশকেই যদি হিসাবে ধরি তাহলে এখন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি লোক প্রয়োজনীয় ক্যালরি খাবার পাচ্ছেন না। এদের কথা সরকার, শাসকগোষ্ঠী ও মুনাফালোভীরা ভাবছে না। আমাদের করোনা থেকে উদ্ধার সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ভেতরে এবং বাইরে কয়েকটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে।
বক্তারা আরও বলেন, আমাদের ধনী লোকরা দেশের ভেতরে বিনিয়োগ করছেন না। তাদের অনেকের সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, হচ্ছে। দেশের চেম্বারগুলোর নেতারা এর বিরুদ্ধে বলেন, কিন্তু নিজেরা সুযোগ পেলে কী করবেন তা বলা কঠিন। প্রায় প্রতিটি আমদানি পণ্যের দাম বেশি করে দেখিয়ে মূল্যবান ডলার বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রফতানি পণ্যের দাম কৃত্রিমভাবে চুক্তি করে কম দেখিয়ে বাড়তি ডলার আর বিদেশেই রেখে দেওয়া হচ্ছে।
সিপিবি নেতারা বলেন, আমাদের দেশের ধনীরা বিদেশে ভোগ-বিলাস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছেন, কেউ কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করে ডলার উপার্জনও করছেন— কিন্তু এগুলি কিছুই দেশে ডলারের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে না। সরকার এক টাকার মেগা প্রজেক্টে তিন টাকা ব্যয় করছে। সে জন্য চীন, জাপান, ভারত, আই.এম.এফ থেকে প্রচুর ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে। শিগগির এসব ঋণ শোধের জন্য সরকারকে ডলারের রিজার্ভ থেকে ডলার দিতে হবে। সম্প্রতি বিদেশে অবস্থানরত দরিদ্ররা বর্ধিত বাজার বিনিময় হারের সুযোগ নেওয়ার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছে। এর ফলে এসব ডলার শেষ পর্যন্ত কোথায় আছে তার হিসাব মিলছে না।
সরকার উদারভাবে জনগণের টাকা থেকে ঋণ নিয়েছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, ব্যক্তিখাতকেও বৃহৎ ঋণ দিয়েছে। সুদের হার দীর্ঘদিন নয়-ছয়-এ সীমাবদ্ধ রেখেছে। তাতে কী হয়েছে। ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ তারা শোধ করতে পারছেন না, অনেকে শোধ করছেন না। ফলে খেলাপি ঋণ জমা হচ্ছে। নতুন উৎপাদনশীল ছোট পুঁজিপতিরা ঋণ বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার এখন নতুন করে হরে দরে ল্যান্ডিং রেট বাড়াতে চাচ্ছেন। সরকারের যুক্তি হচ্ছে যেহেতু এখন জিনিসপত্রের দাম শতকরা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সেহেতু ৯ শতাংশ সুদ নিলে আসলে ঋণগ্রহীতার ১ শতাংশ প্রকৃত লাভ থেকে যাবে। সরকার যে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের উপর মাত্র ৬ শতাংশ সুদের হার ধরে রেখেছিলেন, তাতে যে তাদের ইতোমধ্যে ৩ শতাংশ লস হয়ে গেল সেটা কে ভাববে?
আমাদের দেশ অনেকগুলো পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় উল্লেখ করে তারা বলেন, কৃষিখাতে আমরা অনেকগুরো পণ্য প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারলেও বাজারে তাদের দামের কোনো আগা-মাথা পাওয়া যায় না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম বেড়ে গেলে সরবরাহ বেড়ে যায় এবং দাম কমে আসে। আমাদের এখানে অর্থনীতির এই চিরায়াত নিয়মের কোনো প্রতিফলন বাজারে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে না। পাঁচটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম সরকার উৎপাদন খরচ ও নরমাল মুনাফা হিসাব করে খুচরা ভোক্তামূল্য নির্ধারণ করে সম্প্রতি তা ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের নির্ধারিত দাম লঙ্ঘন করে সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ী ও ফাটকা কারবারিদের কারসাজির কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সিন্ডিকেট ভাঙা, সারাদেশে রেশনব্যবস্থা, ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুসহ উৎপাদক ও ক্রেতা সমবায় গড়ে তোলার দাবিতে আগামী ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, সিপিবির সভাপতি শাহ আলম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ, মিহির ঘোষ প্রমুখ।