তুরাগ নদের প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং তীর দৃষ্টিনন্দন করতে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। পাঁচ বছর আগে বাস্তবায়িত সেই প্রকল্প খুব একটা কাজে আসছে না। অযত্ন, অবহেলায়, দখল আর দূষণে ফের আগের দশায় ফিরছে তুরাগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর পাড় বরাবর নির্মাণ করা হয়েছে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে। রাস্তা থেকে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রয়েছে আরসিসি সিঁড়ি। নদী তীর সংরক্ষণের পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনে কিউ ওয়াল নির্মিত হয়েছে। এসব নির্মাণকাজ শুরুর আগে উচ্ছেদ করা হয় নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাও।
এতসব আয়োজন ঢাকার উত্তর প্রান্ত ঘিরে থাকা তুরাগ নদের প্রবাহ ঠিক রেখে দৃষ্টিনন্দন তীর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এজন্য ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তবে এরই মধ্যে অযত্ন আর অবহেলায় ধীরে ধীরে আগের দশায় ফিরতে শুরু করেছে তুরাগ তীর।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দখলে-দূষণে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তুরাগের পানি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ও স্থানীয় মানুষের ফেলা আবর্জনায় তুরাগ নদের ‘মৃত্যু’ এখন সময়ের ব্যাপার। যদিও এ দূষণ রোধে প্রথমে নদীর তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।
তারপর আরসিসি সিঁড়িসহ হাঁটার রাস্তা, কিউ ওয়াল ও তীর সংরক্ষণসহ মোট পাঁচ ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় তুরাগ নদের টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তে। দখল উচ্ছেদ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এসব ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।
এতে টঙ্গী অংশে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও ঢাকা অংশে ১৭ কোটি ২৮ লাখ ১১ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দ্রুতই জীর্ণ হয়ে পড়ছে নির্মিত স্থাপনাগুলো। উল্টো এসব অবকাঠামোর ওপরেই চলছে নানা কর্মযজ্ঞ।
টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তের মোট ৩ হাজার ৩৮০ মিটার দীর্ঘ হাঁটার রাস্তার অনেকটাই দখল করে রাখছেন হকাররা। ওয়াকওয়ের ওপরই দেখা গেল ১০টি ছাগল বিক্রির জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন মজনু মিয়া নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, ‘মানুষ এ পথে হাঁটাচলা করে। পথ চলতে ছাগল দরদাম করে। তাই এখানেই বসেছি।’ পাশেই কামারের দুটি দোকান। ওয়াকওয়ের ওপর ব্যবসা করা অনৈতিক স্বীকার করে তাদের একজন বললেন, ‘পেটের দায়ে করি। এখানে কাউকে ভাড়া দিতে হয় না।’
কামারদের দোকানের ভাড়া দিতে না হলেও উল্টোপাশে যেখানে আগে টঙ্গীবাজার ছিল, সেখানকার দোকানিদের দিতে হয় অর্থ। মাছ-মাংস-মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রায় শখানেক দোকান রয়েছে ওই এলাকায়।
মসলার দোকানি আসিফ বলেন, ‘আগে এখানে বাজার ছিল। বিআইডব্লিউটিএর লোকজন তা ভেঙে দিয়েছে। এখন সিটি করপোরেশনের লোকজনকে দৈনিক ৬০ টাকা খাজনা দিয়ে দোকান করছি আমরা।’ টঙ্গী ব্রিজের পাশেই একটি পাঁচতলা ভবন গত বছর বিআইডব্লিউটিএর অভিযানে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। সে ভবনের জায়গায় এখন নার্সারির ব্যবসা করছেন আকতার হোসেন।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ডা. হাফিজা খাতুন বলেন, পরিকল্পনা নেয়ার সময় তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা উচিত। ওয়াকওয়ে নির্মাণের সময় এটার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। তা না হলে মানুষ এসব অবকাঠামো ব্যবহার করেই নদী দূষণ করবে। এক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি স্থানীয় প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে।
তিনি বলেন, নগরের বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে নদীতে। আবার মানুষও সচেতন নয়। অথচ তাদের সুবিধার জন্যই এসব নির্মাণ করা হয়েছে। নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন, নয়তো কোনো সংস্থার পক্ষে একা নদী রক্ষা সম্ভব হবে না।
দূষণে নদীর বাস্তুসংস্থান বদলে যাওয়ায় আগের মতো পাওয়া যায় না মাছ। এ কারণে নদীর মাছ ধরে এক সময় যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন অন্য পেশায়। সম্প্রতি তুরাগ তীরে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন বানানো আরসিসি সিঁড়িতে সারি সারি কাপড়ের স্তূপ। ১০টি ড্রামে মা-ছেলে কাপড় ধুচ্ছেন। ধোয়ার কাজে তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরো তিনজন।
‘নদীর মাছ বিক্রি করেই আমাদের বাপ-দাদারা সংসার চালাতেন। নদী এখন মরে যাচ্ছে’-বলছিলেন টঙ্গীর তুরাগ নদের পাশে গরুহাটা বাজার মোড়ে দাঁড়ানো চল্লিশোর্ধ্ব মোমেনা বেগম। তিনি জানান, টঙ্গীবাজারে দোকান ছিল। গত বছর উচ্ছেদ অভিযানের পর ব্যবসা দাঁড় করানো আর সম্ভব হয়নি। এখন সপরিবারে ধোপার কাজ করছেন। নদীর পানিতে কেমিক্যাল মেশানো কাপড় ধুতে কেউ নিষেধ করে না—এ প্রশ্নের উত্তরে মোমেনা বলেন, ‘অনেক দিন এখানে কাজ করছি। কেউ কখনো নিষেধ করে নাই।’
টঙ্গী ও ঢাকার দুই পাশে ওয়াকওয়ের রেলিং বেশ কয়েক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। কোথাওবা স্থানীয় দোকানি ও এলাকাবাসী নিজেদের সুবিধামতো তা ভেঙে নিয়েছে। রাস্তাও ভেঙে গেছে অনেকখানি। তবে বেশ কয়েকটি আরসিসি সিঁড়ি অক্ষত দেখা গেছে। অক্ষত থাকার মূল কারণ হলো সেগুলো মানুষ ব্যবহার করে না। তীর সংরক্ষণের সীমানা ও নদীর পুরো অংশই ময়লা-আবর্জনায় একাকার। তবে অব্যবহূত আরসিসি সিঁড়ির ওপর ময়লার বিশাল স্তূপ দেখা গেছে। যেন এসব সিঁড়ি ময়লা ফেলার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অল্প কয়েকটি সীমানা খুঁটি এখনো রয়ে গেছে। অনেক সীমানা খুঁটিই ভেঙে গেছে বা ভেঙে ফেলা হয়েছে। যদিও বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে গত বছর নতুন করে ১০০ বছর মেয়াদি সীমানা খুঁটি নির্মাণ করা হয়েছে। খুব মজবুত হওয়ায় সেগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি। ভাঙতে না পেরে এসব খুঁটির পাশেই বাড়ি, ঘর, দোকানপাট নির্মাণ করেছে দখলদাররা। ওয়াকওয়ের পাশ ঘেঁষে কোনো বসতভিটা কিংবা স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ না থাকলেও তুরাগের দুই পাশেই আইন অমান্য করে গড়ে উঠেছে বসতভিটা ও দোকানপাট।
বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেও নদী দখল ও নদীর প্রবাহ বজায় রাখতে না পারার কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএর লোকজন হঠাৎ হঠাৎ এসে উচ্ছেদ করে যায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর কোনো তদারকি করে না। তাই উচ্ছেদের পর আবারো দখল হয়ে যাচ্ছে নদীতীর।
বর্জ্য-আবর্জনায় দূষিত হয়ে পড়েছে তুরাগের পানি। দূষিত পানির দুর্গন্ধে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটা দায়। নদীতে বর্জ্য না ফেলার ব্যাপারটি সিটি করপোরেশনের দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও তারাই তুরাগের পানি দূষণে দায়ীদের অন্যতম। গত বছর কয়েকটি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
ওই অভিযানে গুঁড়িয়ে দেয়া বিভিন্ন স্থাপনার অংশবিশেষ এখনো পড়ে রয়েছে তুরাগের তীরে। স্থানীয়রা জানান, প্রথমদিকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে অল্প কিছু ময়লা সরিয়ে নিয়েছিল। কয়েকদিন পর সিটি করপোরেশনই উল্টো সেখানে ময়লা ফেলতে শুরু করে।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন গবেষক ড. ফাতেমা রোকশানা বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকার নদীগুলো নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়। তখন দেখা গেছে, তুরাগের ওয়াকওয়ে ও সিঁড়ির ওপর ময়লার স্তূপ। এখনো বোধহয় একই অবস্থা হবে। যেখানে ‘ময়লা ফেলা যাবে না’ সাইনবোর্ড লেখা থাকে, মানুষ সেখানেই ময়লা বেশি ফেলে। আরেকটা ব্যাপার হলো, ওয়াকওয়ে বা সিঁড়ির ওপর ময়লা ফেললে ক্ষতিটা বেশি হয়। আবর্জনটা তখন পচতে সময় নেয় ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত করে ফেলে। সরকারের ভালো ও প্রশংসনীয় পরিকল্পনাও সঠিক বাস্তবায়ন ও তদারকির অভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রসঙ্গত, তুরাগ নদের টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তে হাঁটার রাস্তা, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে, কিউ ওয়াল, তীর সংরক্ষণ এবং আরসিসি সিঁড়িসহ পাঁচ ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ ব্যয়ে তুরাগ নদের টঙ্গী প্রান্তে হাঁটার রাস্তা ১২৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ১২৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬৭৫ মিটার, কিউ ওয়াল ৩৩৫ মিটার এবং ১৫টি আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে তুরাগের ঢাকা প্রান্তে নির্মাণ করা হয় হাঁটার রাস্তা ২০৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ২০৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬২৫ মিটার এবং আরসিসি সিঁড়ি ১৮টি।
জানা গেছে, দূষণ রোধে তুরাগসহ ঢাকার চার নদ-নদীর প্রবাহ বজায় রাখতে ২০১১ সালের ২৯ মার্চ ৯৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। ‘ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গী নদীবন্দরের উচ্ছেদকৃত ফোরশোর ভূমিতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও একদফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৪ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়। বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় মেয়াদে নির্মাণকাজ শতভাগ সমাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে ২৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা কম খরচ হয়। ১০৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অনুমোদিত বাজেটের বিপরীতে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১০৭ কোটি ৫৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
গত বছরের জুনে প্রকাশিত আইএমইডির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, টঙ্গী নদীবন্দরের উচ্ছেদকৃত ফোরশোর ভূমিতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের পর উচ্ছেদকৃত জায়গা যেন ফের দখল করতে না পারে, এজন্য বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। মানুষের সুবিধার জন্য বসার বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে ও কৃষিকাজের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে গত সোমবার সরেজমিন পরিদর্শনে ফোরশোর ভূমিতে কোনো বৃক্ষ বা বেঞ্চ দেখা পাওয়া যায়নি। কৃষিকাজের কোনো সুযোগও সেখানে সৃষ্টি হয়নি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নির্মিত ভৌত অবকাঠামো তাদের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং কয়েকদিন পরপর দখল ও উচ্ছেদ হয়। আর এতে সমস্যায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকেই।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত যে প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে, সেখানে নদীর সীমানা নির্ধারণের হিসাব সঠিক ছিল না। ফলে এখন আবার নতুন করে ১০০ বছর মেয়াদি সীমানা পিলার বসানো হচ্ছে। এসব সীমানা পিলারও মানুষজন দখল করে ফেলছে।
সামগ্রিক বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়্যারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ভৌত অবকাঠামো ভেঙে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে—এমন কোনো অভিযোগ পেলে তা মেরামত করে দিই। অনেক জায়গাতেই অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মেরামত করেছি। তুরাগ থেকে কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। নদী দূষণের বিষয়টি মূলত পরিবেশ অধিদপ্তর তদারকি করে। নদীর প্রবাহ বজায় রাখার বিষয়টি দেখছি আমরা। এ সময়টাতে নদীর পানি কম থাকে। তবুও সেখানে ট্রলার নৌকা চলছে।