নিজস্ব প্রতিবেদক : পাবনা জেলার সাঁথিয়া ও আটঘরিয়া উপজেলার গ্রামীণ সড়কে দুটি ব্রিজ নির্মাণ করছে এলজিইডি। বিশ^ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ব্রিজ দুটির নির্মাণকাজ শেষ হলে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকার মান পাল্টে যাবে। স্থানীয়রা জানান, ব্রিজ দুটি নির্মাণ শেষ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। ব্যবসার প্রসারের পাশাপাশি বাড়বে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। এলজিইডি সূত্র জানায়, ব্রিজ দুটি নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। বর্ষার কারণে কাজের কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। সরেজমিনে ব্রিজ এলাকা পরিদর্শন কালে সংশ্লিষ্ট ব্রিজ দুটির নির্মাণ শ্রমিক, পথচারি, ব্যবসায়ী, স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন তাদের প্রতিক্রিয়া।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাঁথিয়া উপজেলার চিনখাপাড়া এলাকায় চিনাখড়া-বনগ্রাম জিসি-চিনাখাড়া জিসি ভায়া চিনখাপাড়া দারোগা বাড়ি সড়কে ১৫ মিটার দীর্ঘ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রোগ্রাম ফর সাপোর্টিং রুরাল ব্রিজেসের আওতায় ব্রিজটি নির্মাণ করছে এলজিইডি। (প্যাকেজ নং SupRB/Pab/New/21-22/w-36).
ইতোমধ্যে সেতুটির ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে। এতে সাঁথিয়া উপজেলার হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হবে।
নতুন করে নির্মিত হচ্ছে চিনাখাড়া আরসিসি গার্ডার ব্রিজটি। ১৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটির প্রস্থ ৯.৮০ মিটার এবং উচ্চতা ৪.৫ মিটার। চুক্তি মূল্য ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার তিনশ নিরানব্বই টাকা। এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২৪ জুলাই ২০২২। যা শেষ হওয়ার কথা ছিল এই বছরের ২৪ জুন। তবে নির্দিষ্ট সময়ে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী। এরই মধ্যে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী জানান, বর্ষা মৌসুমে এ সেতুর সাবস্ট্রাকচার করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া সাব-স্ট্রাকচারের জন্য নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন। বিশেষ করে সেতু পর্যন্ত অ্যাপ্রোচ রোডের দুই পাশে বাঁধের কাজ করতে অনেক সময় লাগবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ আলী জানান, সেতুটি নির্মাণ করা হলেও এর অ্যাপ্রোচ রোড এখনো নির্মাণ করা হয়নি। এপ্রোচ রোড থাকলে যাতায়াত সুবিধা হবে। এখন মনে হচ্ছে খালি মাঠে একটা সেতু তৈরি হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, চিনাখাড়া-বনগ্রাম জিসি-চিনাখাড়া জিসি হয়ে চিনাপাড়া দারোগা হাউস সড়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে সেতু না থাকায় অনেক অসুবিধা হতো। সেতুটি নির্মিত হলে এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। স্থানীয় কৃষক নায়েব আলী জানান, সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান, ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এটা আমাদের জন্য খুবই উপকারী হবে। কম খরচে পণ্য পরিবহন করা যাবে। স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা বিলকিস আক্তার জানান, সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবে। তারা সহজে যাতায়াত করতে পারে। এখন তাদেরকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে স্কুল-কলেজে যেতে হচ্ছে। সেতু হলে দূরত্ব অনেক কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, গর্ভবতী মহিলা, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরাও চিকিৎসার জন্য এই সেতু ব্যবহার করে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবেন।
সেতু সংলগ্ন চিনাখাড়া এলাকার বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রহমান মিয়া জানান, অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ধুলো-বালি যাতে পরিবেশ দূষিত না করে সেজন্য প্রতিনিয়ত পানি ছিটানো হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলাদা আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, ভারী বা বিপজ্জনক কাজ করার সময় তাদের বুট, জ্যাকেট এবং ক্যাপ পরতে হয়। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থাও করেন ঠিকাদার। প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য সর্বদা শ্রমিকদের বিশ্রামাগারে ‘ফার্স্ট এইড’ বক্স রাখা হয়। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রায়ই নির্মাণাধীন সেতু পরিদর্শন করেন।
এদিকে, আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা-ইউপি অফিস-গারুরী জিসি রোডে ১১ দশমিক ৫ মিটার দীর্ঘ বক্স কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। (প্যাকেজ নং SupRB/Pab/Replace/22-23/w-344.)
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এটি বাস্তবায়ন করছে। সেতুটি নির্মাণে বাজেট এক কোটি ১৩ লাখ এক হাজার সাতশত চৌদ্দ টাকা। আগে একই স্থানে একটি ছোট সেতু ছিল। সেটা দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় এখানে নতুন একটি বড় বক্স কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ এলাকায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
বক্সকালভার্ট সেতুটি ৫ মিটার উঁচু এবং ৭.৩ মিটার চওড়া। ২০২৪ সালের ১২ মে এটি শেষ হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে এরই মধ্যে ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
চাঁদভা-ইউপি অফিস-গারুরী জিসি সড়কে যেখান থেকে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে সেখান থেকে স্থানীয় বাজার কয়েক মিটার দূরে। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই হাটে আসেন। বাজারে আসা-যাওয়ার পথে আগের সরু সেতুটি যান চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি করতো। পুরাতন সেতুর জায়গায় নতুন বক্স কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণ করায় এলাকাবাসী খুবই খুশি। সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ এলাকার মানুষ অনেক উপকৃত হবে বলে জানান তারা।
স্থানীয় বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলী আজগর বলেন, সেতুর কাজ শেষ হলে আমাদের যাতায়াতের সুবিধা হবে। তখন সহজেই মালামাল আনা-নেওয়া করা যাবে। ভাড়া কম হবে। মানুষ আসবে। বিক্রি বাড়বে। অটো চালক সেলিম জানান, সেতু নির্মাণের আগে বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে সড়কটি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আসা-যাওয়া একটু কষ্ট হলেও খুব ভালো কাজ হচ্ছে।
অটো রিকশার যাত্রী বোরহান উদ্দিন জানান, সেতুর কাজ চলাকালে মাঝে মাঝে পানি ছিটানো হয় যাতে চারপাশে ধুলাবালি না উড়ে। তবে সব সময় পানি ছিটালে পরিবেশ দূষণ কমবে। সেতু নির্মাণে তিনি খুশি বলে জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, সেতু নির্মাণের আগে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে অঅমি বিস্মিত। বেশ ভালো আয়োজন। মানুষের চলাচল যাতে বন্ধ না হয় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অ্যাপ্রোচ রোড ভালোভাবে করা হয়েছে। বর্ষায় পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
নির্মাণাধীন সেতুর পাশের এক বাসিন্দা জানান, শ্রমিকরা খুবই সুন্দর পরিবেশে কাজ করছেন। এখানে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। পুরুষদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, ধুলা নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝে পানি ছিটানো হয়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সাইনবোর্ড না থাকলেও এখানে তেমন শব্দ দূষণ নেই বলেও জানান তিনি।
নির্মাণ শ্রমিক আব্দুল হক বলেন, আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ কার। মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি পাই। সেজন্য পৃথক রুম আছে। শ্রমিকদের জন্য টয়লেট আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছি বলেই কাজ করছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অপর এক নির্মাণ শ্রমিক বলেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কাজ ভারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ না হলে শ্রমিকরা বুট এবং হেলমেট পরতে চান না।
স্থানীয় একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী জেসমিন আরা বলেন, “আমরা স্কুলে যাওয়ার জন্য এই রাস্তাটি ব্যবহার করি। আগে যানবাহন চলাচল করা খুবই কষ্টকর ছিল। অ্যাপ্রোচ রোডে এখনও ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করে। এটা খুব একটা সমস্যা না। তিনি বলেন, সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। ভ্রমণের সময় অনেকটাই কমে যাবে। যখন তখন রিকশা বা অটোরিকশা পাওয়া যাবে।
আটঘরিয়া উপজেলা সদরের বাসিন্দা মোটরসাইকেল আরোহী সোহাগ জানান, সেতুটি বড় হওয়ায় এ এলাকার মানুষ অনেক উপকৃত হবে। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষিসহ সব ধরনের ব্যবসার উন্নতি হবে। এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হবে। আমরা আশা করছি কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করবেন।