নিজস্ব প্রতিবেদক :
সপ্তমবারের মতো ভেঙেছে প্রয়াত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গঠিত জাতীয় পার্টি। এবার দলটির সদ্য বহিষ্কৃত নেতা আনিসুল ইসলাম ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্ব একই নামে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে।
শনিবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে ইমানুয়েল কমিউনিটি সেন্টারে সদ্য বহিষ্কৃত ৭ নেতাদের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টির কাউন্সিল হয়।
সেখানে আগত কাউন্সিলরদের কণ্ঠভোটে নতুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর মহাসচিব হয়েছেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।
কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে জাতীয় পার্টি গঠিত তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক মো. জহিরুল ইসলাম জহির নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব হিসেবে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের নাম ঘোষণা করেন। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন– মোস্তফা আল মাহমুদ ও মো. আরিফুর রহমান খান।
এ ছাড়া কাজী ফিরোজ রশিদ সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
উদ্বোধনী অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (রওশন এরশাদ) অংশের নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা প্রমুখ।
কাউন্সিলে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টি (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য দিদারুল আলম দিদার, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দেশ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমাদের দেশকে একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছিলাম। আজ সবাই সব কথা বলে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার কথা কেউ বলে না।
তিনি বলেন, এখন সরকার বলছে সংস্কার করতে হবে। সংস্কার কি আমরা করিনি। শিক্ষানীতি, ঔষধনীতি, উপজেলা পদ্ধতি– এসবই সংস্কারের অংশ ছিল। এখন সংস্কারের জন্য বিদেশ থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হয়। তারা কীভাবে সংস্কার করবে। তারা সংস্কারের প্রস্তাবনা দিতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচিত সংসদ লাগবে। নির্বাচনে কথা উঠছে কিন্তু কীভাবে নির্বাচন হবে। আদৌ নির্বাচন হবে কি না জানি না। তাছাড়া দেশে এখন যে পরিবেশ বিজার করছে তাতে নির্বাচন কি দরকার। বড় দুই দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে নিলে নির্বাচনের খরচ বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা বেচে যায়।
সভাপতির বক্তব্যে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সরকার সংস্কার করছে কিন্তু এই সংস্কার তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচিত সংসদ দরকার। আর সংসদের জন্য দরকার জাতীয় নির্বাচন। যদিও সরকার নির্বাচনের কথাও বলছে। কিন্তু আদৌ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। কিন্তু সরকার তা করছে না।
বিভাজনের রাজনীতি বাদ দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। সারা দেশে চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, দখলবাজি চলছে। মানুষ খুন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাংবাদিকরাও হত্যার শিকার হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, দলের গঠনতন্ত্রের ‘বিতর্কিত’ ২০(ক) ধারাকে কেন্দ্র করে ফের ভাঙন দেখা দেয় জাতীয় পার্টিতে। দলের নেতারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা অনুযায়ী জাপা চেয়ারম্যান কারণ দর্শানো ছাড়াই দলের যে কাউকে পদ থেকে সরাতে পারেন, বহিষ্কার করতে পারেন। যে কাউকে যেকোনো পদ দিতে পারেন। এজন্য তাকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। যে কারণে দলের বর্তমান কমিটির সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ বর্তমান চেয়ারম্যানকে এই ধারা সংশোধন করার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তা পরিবর্তন করতে আগ্রহী নন। তাই এই অংশটি যেকোনো সময় পদ হারানোর ভয়ে এখন জিএম কাদেরকে একঘরে করে সম্মেলন করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জাতীয় পার্টি থেকে বিভিন্ন সময় পদ হারানো নেতারা।
বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই নামে সবচেয়ে বেশি ব্র্যাকেটবন্দি হয়েছে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টি। বর্তমানে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে সাতটি দলের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের ভাই ও স্ত্রীরা।
এরশাদের জীবদ্দশায় ‘জাতীয় পার্টি’ নামে পাঁচটি দল ছিল। মৃত্যুর পর (১৪ জুলাই, ২০১৯) তার সাবেক স্ত্রী বিদিশার ইচ্ছায় ‘নতুন জাপা’ নামের আরেকটি দল হয়। সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।
বর্তমানে ব্র্যাকেটবন্দি জাপার অংশগুলো হলো– জাতীয় পার্টি (জাপা), চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের; নতুন জাপা, এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক; জাতীয় পার্টি (জেপি), সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ; জাতীয় পার্টি, চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ; বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, সভাপতি ডা. এম এ মুকিত এবং জাতীয় পার্টি, চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।