নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিজয় উদযাপন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে নেমেছে মানুষের ঢল। লাখো মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ করছেন দেশ মাতৃকার টানে জীবন উৎসর্গকারীদের। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা।
হাজার হাজার মানুষ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নানা আনন্দে মেতে উঠেছেন। শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মুখে, হাতে জাতীয় পতাকার ছবির পাশাপাশি স্মৃতিসৌধের ছবি এঁকেছেন কেউ কেউ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীন দেশ, সেই শহীদদের স্মরণে শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) রাতের প্রথম প্রহরেই ঘন কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করে স্মৃতিসৌধ এলাকায় আসতে থাকে মানুষ।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হয় সকাল সাতটার দিকে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর এসব মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে যায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদি।
ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। সাড়ে ছয়টার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় দুজন সেখানে কিছু সময়ের জন্য নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের শ্রদ্ধা জানানোর পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য স্মৃতিসৌধ এলাকায় খুলে দেওয়া হয়। এরপর ফুল হাতে জনতার ঢল নামে সৌধ প্রাঙ্গণে। অল্প সময়ের মধ্যে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদের স্মৃতির মিনার।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্মৃতিসৌধ এলাকা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বিজয় দিবসের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে স্মৃতিসৌধ এলাকা থেকে শুরু করে গোটা সাভার পরিণত হয়েছে উৎসবের নগরীতে। শিশু-ছেলে-বুড়োসহ সব বয়সী মানুষের উপস্থিতি অন্যরকম এক আবহের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ। তাদের ফুলেল শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে শহীদ বেদী। স্মৃতিসৌধে আসা অনেকের হাতে দেখা যায় লাল-সবুজের পতাকা আর রঙবেরঙের ফুল। পোশাকেও লাল-সবুজের সরব উপস্থিতি। অনেকের হাতে শোভা পাচ্ছে ব্যানার। অনেকের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে দেশের গান।
সাভারের আশুলিয়া থেকে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এই দিনটি ভীষণ গৌরবের। আর সেটিকে উদযাপনে এখানে আসা।’
তানিয়া আক্তার নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেটিকে অস্বীকার করে জাতি এগিয়ে যেতে পারবে না। আর বিজয় দিবস একটি দিন, যেদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার জালিয়ে নিতে পারি। যেন সারা বছর এটিকে লালন করতে পারি।’
আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রতি বছর পুরো পরিবারসহ এখানে আসি। প্রচুর মানুষ আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা তার প্রমাণ এটি।’
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু যুদ্ধ দেখেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যারা আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন তাদের ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা যাবে না।
তিনি বলেন, আমি প্রতিবছর চেষ্টা করি স্মৃতিসৌধে এসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর। ১৬ ডিসেম্বর এখানে এলে অন্যরকম ভালো লাগে। মনটা গর্ভে ভরে যায়। প্রতিবছর এখানে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষের এমন উপস্থিত দেখে মনটা আনন্দে ভরে যায়।
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মহিমা আক্তার বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে এখনো এক বছর হয়নি। আগে গ্রামের বাড়ি থাকতাম। বিয়ের পর ঢাকায় এসেছি, চার মাসের মতো হলো। রোহান (স্বামী) নিজ উদ্যোগে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের বিয়ের পর এটা প্রথম বিজয় দিবস, দুজন এক সঙ্গে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
এছাড়া শ্রদ্ধা জানাতে আসেন রাজনীতিক, কূটনীতিক, সমাজকর্মী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ।
ভিভিআইপি যাতায়াতের কারণে ভোর রাত থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানবাহন ও মানুষের চলাচল বন্ধ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর মহাসড়ক ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর আগে দিবসটি পালনে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে প্রায় এক মাস ধরে ধুয়ে-মুছে, রংতুলির আচড় ও রঙ-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেই সাথে স্মৃতিসৌধে আগত দর্শনার্থীসহ সবার নিরাপত্তা ও কোনো প্রকার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এখানকার পুলিশ ও আনসার ক্যাম্পকে সর্বোচ্চ সকর্কতামূলক অবস্থানে রাখা হয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মহান বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে না পারে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।