নিজস্ব প্রতিবেদক :
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে বুধবার (২৩ আগস্ট) স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় হোটেল হিলটন স্যান্ডটনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের থিয়োম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর এবং অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘ চার বছর পর শেখ হাসিনা ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হলো। আর বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন ও বাংলাদেশের এ বৈঠককে বেশ গুরত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপের মধ্যে হওয়া বৈঠক বিশেষ কোনো বার্তা দিতে পারে।
২২-২৪ আগস্ট চলমান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ২২ আগস্ট জোহানেসবার্গে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চীনের প্রেসিডেন্ট সোমবার মধ্যরাতে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছান।
আগামী ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ এবং ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) ‘ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেবেন।
ব্রিকসে যোগদানে সহায়তা প্রদান এবং রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করাসহ সব প্রয়োজনে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ১৫তম ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি বলেছেন, আমি সবসময় আপনাকে (শেখ হাসিনা) সমর্থন করব, কারণ আপনি ব্রিকসে যোগ দিতে পারেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে চীন বাংলাদেশকে সাহায্য করবে…আমরা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা চাই না।
বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে হোটেল হিলটন স্যান্ডটনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শি চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে চান।
মোমেনের মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করতে চায়। বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকরা আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই অবৈধ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত। শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি অপরিহার্য।
জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অবকাঠামোর উন্নয়নে ঢাকাকে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। এ সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে বাংলাদেশকে সব সময় সমর্থন করবেন বলে আশ্বাস দেন।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন শি। তিনি বলেন, চীন আপনাকে দ্রুততম সময়ে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
শেখ হাসিনা চীনের অর্থায়নে পরিচালিত কিছু প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে শির কাছে সাহায্য চেয়েছেন, যা এখন তহবিল সংকটের জন্য আটকে আছে এবং চীনা রাষ্ট্রপতি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করে এবং চীন মাত্র ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করে।
এরপর চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেন চীনা প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, তার দেশ চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে কিছু চীনা বিনিয়োগ এলে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমবে। তিনি দুই দেশের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। উত্তরে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা দুই দেশের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ চীনে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, তাজা শাকসবজি, গবাদি পশু ও পোল্ট্রি ফিডের মতো তাজা ফল রপ্তানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
আগামী অক্টোবরে পদ্মা রেলসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে চীনের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জবাবে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি অবশ্যই আপনার দেশে আসব। তবে সফরের সময় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে।
বৈঠকে চীনের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। বাংলাদেশ-চীনের সুসম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে চলে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করে বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত। এ ছাড়া ব্রিকসের মতো বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় সহযোগিতা জোরদার করতেও প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। ব্রিকসের কার্যপদ্ধতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন উন্নয়নের সুযোগ নিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ।