নিজস্ব প্রতিবেদক :
ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়বদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা বন্ধে অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বহুমুখী সংকটে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ এবং সংঘাতের ফলে ব্যাপকভিত্তিতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, বিশেষত নারী এবং শিশুদের সাথে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির (ইমিডিয়েট অ্যান্ড কমপ্লিট সিসফায়ার) আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই (টু স্টেট সল্যুশন) মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে, তাই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব সর্বব্যাপী। এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। আমরা তাই উভয়পক্ষকেই সংলাপে বসে বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানাচ্ছি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অভিবাসীদের মানবাধিকার ও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত বিশ্বে বসবাস করছি, সেখানে অভিবাসন এবং মানুষের অবাধ প্রবাহ এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। বাংলাদেশি নাগরিকেরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে যাচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। সবার জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অভিবাসীদের মানবাধিকার এবং তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অভিবাসনের ওপর ২০১৮ সালে যে গ্লোবাল কমপেক্ট অন মাইগ্রেশন গৃহীত হয়েছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং একই সঙ্গে অনিরাপদ অভিবাসন রোধেও আমরা বদ্ধপরিকর।
প্রতিবছর প্রায় পঁচিশ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন বলে জানান অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। এই জনশক্তিকে বর্তমান ও আগামীর জন্য গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
তিনি আরও বলেন, ক্রমপরিবর্তনশীল কর্মজগতে (ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক) একজন তরুণকে প্রতিনিয়ত নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয় এবং কর্মপরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শিখতে হয়। এজন্য বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হচ্ছে, তখন আমরা শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভের উপর বিশেষ জোর দিচ্ছি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় বিকাশ এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগে বাংলাদেশ বিশেষভাবে আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের তরুণ সমাজ জেনারেল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তারাও চায় নতুন পৃথিবীতে নিয়োজিত হতে, কর্মক্ষম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের মতো বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগজনিত অর্জিত সুফল থেকে পিছিয়ে না পড়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, নিশ্চিত করতে হবে যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা সংকুচিত হয়ে না যায়।
তিনি আরো বলেন, মানুষের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সম্প্রসারিত করতে পারে। এ বিষয়ে আমরা বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তারা যেন এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আগে মানুষের উপর এর প্রভাব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হন। আমাদের ধারণা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের সামনে নিজের উদ্ভাবিত ‘তিন শূন্যের’ ধারণা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্দিষ্ট করে বললে, আমাদের দরকার জীবনরক্ষাকারী প্রযুক্তি, বিশেষত কৃষি, পানি এবং জনস্বাস্থ্য খাতে, যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভাবন এবং সমাধান ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পারে। জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের যুগপৎভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় এখন কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে মনোযোগী হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে এ ধরনের পরিবর্তনের সুফলভোগী করতে হলে, নেট-জিরো পৃথিবীর লক্ষ্য সমানভাবে পূরণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে সঙ্গে নিতে হবে। তা না হলে, ‘পারস্পরিক দায়িত্ববোধের’ মাধ্যমে ‘পারস্পরিক সমৃদ্ধি’ অর্জনে আমাদের সর্বজনীন অঙ্গীকার পূরণে আমরা পিছিয়ে পড়বো।
নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, এক্ষেত্রে আমি বিশ্বাস করি যে সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে ‘তিন শূন্য’-এর ধারণা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি তরুণ-তরুণী চাকরি প্রার্থী না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে। তারা যেন সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজ নিজ সৃজনশীলতার বিকাশ করতে পারে, যেখানে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য আনতে মনোযোগী হতে পারে, যেখানে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে যেকোনও ব্যক্তি ভোগবাদী জীবনধারা থেকে উত্তরণ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সৃজনশীল শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।
এই সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশ ও বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন একতা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে, এই লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ ব্যবস্থা, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সরকারগুলো, সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অংশীজন (এনজিওগুলো) এবং দাতব্য সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামাজিক ব্যবসাকে স্থান দিলেই নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। এই পদক্ষেপ একই সঙ্গে জলবায়ুর ধ্বংসাত্মক গতিকে সফলভাবে রোধ করতে পারে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ড. ইউনূস।