নিজস্ব প্রতিবেদক :
ফেনীর এক পুলিশ পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা হয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার এই মামলা করেন। মামলায় ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও শাশুড়িকেও আসামি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) দুদকের পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজ বাদী হয়ে স্থানীয় দুদক কার্যালয়ে মামলাটি করেন।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ বর্তমানে ফেনী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পুলিশ পরিদর্শক (ক্রাইম শাখা) হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া তালুকপাড়া গ্রামে। তিনি ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এজাহারে বলা হয়, পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার সাবেক ওসি ও বর্তমানে ফেনী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের অপরাধ বিভাগের ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত সৈয়দ আব্দুল্লাহ (৫৬), তার স্ত্রী ফারহানা আক্তার (৪৫) এবং শাশুড়ি কারিমা খাতুন (৬২) অবৈধভাবে অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও দখলে রেখে এবং অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন ও ছদ্মাবৃত্ত করা তথা মানি লন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে ২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এর মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা ও দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪২০/১০৯ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২), ৪(৩) ধারায় শান্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তাদের বর্তমান ঠিকানা ঢাকার খিলগাঁও। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় পিরোজপুরের নথি অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি সৈয়দ আব্দুল্লাহ নিজ নামে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটিতে ছয় কাঠা করে দুটি মোট ১২ কাঠার প্লটের জন্য আবেদন করেন। এখন পর্যন্ত যার পরিশোধিত মূল্য ৪০ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা।
সৈয়দ আব্দুল্লাহর শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে গুলশানে ৩৯০৯ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (যার মূল্য মোট ৮ কোটি ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা) কেনার জন্য চুক্তি করেন। ফ্ল্যাট বুকিং ও প্রাথমিক চুক্তিতে কারিমা খাতুনের নাম থাকলেও ওই ফ্ল্যাটের মূল্য ও আনুষঙ্গিক বাবদ প্রিমিয়ার ব্যাংক গুলশান তেজগাঁও লিংক রোড শাখায় আসামি সৈয়দ আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তারের হিসাব নম্বর থেকে ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড গুলশান তেজগাঁও লিংক রোড শাখায় ফারহানা আক্তারের স্পার্ক এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির চলতি হিসাব থেকে ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা নাভানা রিয়েল এস্টেট বরাবর পরিশোধ করা হয়।
আব্দুল্লাহ তার স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে কাকরাইলে ২১২০ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেস ও ২৬৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিংসহ মোট ২৩৮৬ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেস ২ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেনেন। ফারহানা আক্তারের নামে ঢাকা মহানগরীর রমনায় ২১৫০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট ও কার পার্কিং স্পেস কিনেছেন আব্দুল্লাহ, যার মূল্য ২ কোটি ৭৩ লাখ চার হাজার ২৩২ টাকা।
এছাড়াও ফারহানার নামে খিলগাঁওয়ে পুলিশ প্রজেক্টে ২০০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ও ২০০ বর্গফুটের গ্যারেজ কেনার তথ্য পেয়েছে দুদক, যার নির্মাণ খরচ বাবদ ৪০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করেছেন আব্দুল্লাহ। তিনি নিজ নামে দুটি প্লট, স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট, একটি বাণিজ্যিক স্পেস ও শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনা বাবদ ১৫ কোটি সাত লাখ ৬৬ হাজার ৪১৫ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ অর্জন করেন।
দুদক বলছে, সৈয়দ আব্দুল্লাহ প্রতারণার উদ্দেশ্যে তার স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে দুটি এনআইডি কার্ড বানান। আব্দুল্লাহ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত হিসাব খোলা এবং ওই হিসাবগুলোতে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৪ টাকার আমানত গচ্ছিত রাখার তথ্য, বিভিন্ন ব্যাংকে দুটি এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে ১ কোটি টাকা মূল্যের সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ফারহানা আক্তারের নামে ৩ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৪ টাকার অস্থাবর সম্পদ কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সৈয়দ আবদুল্লাহ সরকারি কর্মচারী হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার পদমর্যাদার অপব্যবহার করে ঘুস ও দুর্নীতির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে অর্জিত টাকা নিজের নামে, স্ত্রী ফারহানা আক্তার ও শাশুড়ি কারিমা খাতুনের নামে করেছেন।
আদালতের আদেশে সৈয়দ আবদুল্লাহর অর্জিত স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় পিরোজপুরের সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজ বলেন, অনুসন্ধানে সৈয়দ আবদুল্লাহ এবং তার স্ত্রী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ১৮ কোটি সাড়ে ১৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪–এর ২৭ (১) ধারা ও দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৪২০/ ১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭–এর ৫ (২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২–এর ৪ (২), ৪ (৩) ধারায় মামলা করা হয়েছে।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় পিরোজপুর সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দ আবদুল্লাহ ১৯৯১ সালে উপপরিদর্শক হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ২০০৭ সালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। তিনি ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত মঠবাড়িয়া থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।