Dhaka মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এক বছরে সড়কে নিহত ৭৯০২

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত ও ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। একই সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত ও ৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত, ১৫২ জন আহত ও ১০৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

একই সময়ে ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ জন আহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নিহতের ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ ও আহতের ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৬ হাজার ৯২৯টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫জন নিহত এবং ১০ হাজার ৯৯৯ জন আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (১৪ জানুয়ারী) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত, ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ২৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২০৫ জন নিহত, ২ হাজার ২৯৪ জন আহত হয়েছে। খুলনা বিভাগে ৭৬৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬৪ জন নিহত,১ হাজার ৭৮ জন আহত হয়েছে। বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত, ৯৯২ জন আহত হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন নিখুঁত, ৬৬৫ জন আহত হয়েছে। সিলেট বিভাগে ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন নিহত, ৯২৬ জন আহত হয়েছে। রংপুর বিভাগে ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬ জন নিহত, আহত ৩২১ হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগে ৭৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৯৩ জন নিহত ও ১ হাজার ১৬৮ জন আহত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে প্রতি বছরের মতো এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত, ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৫০ জন চালক, ৯৬৮ জন পথচারী, ৪৮৫ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী, ৯৭ জন শিক্ষক, ১৫৪ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৯৮৫ জন নারী, ৬১২ জন শিশু, ৩০ জন সাংবাদিক, ৩২ জন চিকিৎসক, ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৮ জন আইনজীবী ও ১০ জন প্রকৌশলী এবং ১১১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনায় নিহত ৭৩ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ১৬ জন সেনাসদস্য, ৪০ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন র‌্যাব সদস্য, ৭ জন বিজিবি সদস্য, ৩ জন নৌ-বাহিনীর সদস্য, ৩ জন আনসার সদস্য, ২ জন ফায়ারসার্ভিস সদস্য, ১ জন এনএসআই সদস্য, ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ জন সাংবাদিক, ৬৪৭ জন নারী, ৪৬৬ জন শিশু, ৪১৬ জন শিক্ষার্থী, ৮১ জন শিক্ষক, ১৫২৬ জন চালক, ২৬০ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮ জন প্রকৌশলী, ৭ জন আইনজীবী, ৭৭ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ২২ জন চিকিৎসক।

এতে বলা হয়, গত ১ বছরে সংগঠিত এসব দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৮ হাজার ৫৫০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে, যার ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বাস, ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ- কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ২৬ দশমিক ০২ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।

এছাড়া ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দুর্ঘটনায় সংগঠিত যানবাহনের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক, ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বাস সড়কে দুর্ঘটনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ২৩ দশমিক ২২ শতাংশ নসিমন-মাহিন্দ্ৰা-লেগুনা, ২৩ দশমিক ০৩ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ১৯ দশমিক ০৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-লরি সড়কে দুর্ঘটনা বিগত বছরের চেয়ে কমেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ৮৩ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা, ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বিবিধ কারণে, শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেঁছিয়ে এবং শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২০২২ সালের তুলনায় বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ গাড়ি চাপা, ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেচিয়ে, ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ৩৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, ১৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা কমেছে। এছাড়া বিবিধ কারণে ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুর্ঘটনার ধরণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১ দশমিক ১১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া ও এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে ফিডার রোডে ৫৫ দশমিক ১৯ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এবার আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৯.৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে।

সংবাদ সম্মেলনে এ সময় যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়।

এতে আরও বলা হয়, বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি, এইদিনে ৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছে। ২৬ মার্চ সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, এইদিনে ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে নিহত হয়েছে ৩৭ জুলাই, এইদিনে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত ও ৯৮ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ৪ মার্চ, এইদিনে ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে বেপরোয়া গতি; বিপদজনক অভারটেকিং; রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি; ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল; যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; চালকের অদক্ষতা; যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব; চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার; মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো; রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ; ট্রাফিক আইন অমান্য করা; ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি; সড়কে চাঁদাবাজি; রাস্তার উপর হাট-বাজার; ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালানো; মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা; চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা; সড়কে আলোকসজ্জা না থাকা; রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উচু না থাকা; সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকা এবং দেশব্যাপী নিরাপদ, আধুনিক, স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশগুলো হচ্ছে, করোনার চেয়ে ভয়াবহ মহামারি বিবেচনায় সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার প্রকল্পে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা; নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা; সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে গঠিত সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট শক্তিশালী করা; সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা; দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অংকন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা; গণপরিবহন চালকদের যুগোপযোগী পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা; সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিলে আবেদনের সময়সীমা ৬ মাস নির্ধারণ করা; স্মার্ট গণ-পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া; ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা; উল্টো পথের আলো এবং পথচারীর পারাপার রোধে মহাসড়কের রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উঁচু করা; গণ-পরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণ-পরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

এক বছরে সড়কে নিহত ৭৯০২

প্রকাশের সময় : ০১:৫৭:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত ও ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। একই সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত ও ৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত, ১৫২ জন আহত ও ১০৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

একই সময়ে ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ জন আহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নিহতের ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ ও আহতের ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৬ হাজার ৯২৯টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫জন নিহত এবং ১০ হাজার ৯৯৯ জন আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (১৪ জানুয়ারী) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত, ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ২৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২০৫ জন নিহত, ২ হাজার ২৯৪ জন আহত হয়েছে। খুলনা বিভাগে ৭৬৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬৪ জন নিহত,১ হাজার ৭৮ জন আহত হয়েছে। বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত, ৯৯২ জন আহত হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন নিখুঁত, ৬৬৫ জন আহত হয়েছে। সিলেট বিভাগে ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন নিহত, ৯২৬ জন আহত হয়েছে। রংপুর বিভাগে ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬ জন নিহত, আহত ৩২১ হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগে ৭৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৯৩ জন নিহত ও ১ হাজার ১৬৮ জন আহত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে প্রতি বছরের মতো এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত, ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৫০ জন চালক, ৯৬৮ জন পথচারী, ৪৮৫ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী, ৯৭ জন শিক্ষক, ১৫৪ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৯৮৫ জন নারী, ৬১২ জন শিশু, ৩০ জন সাংবাদিক, ৩২ জন চিকিৎসক, ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৮ জন আইনজীবী ও ১০ জন প্রকৌশলী এবং ১১১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনায় নিহত ৭৩ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ১৬ জন সেনাসদস্য, ৪০ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন র‌্যাব সদস্য, ৭ জন বিজিবি সদস্য, ৩ জন নৌ-বাহিনীর সদস্য, ৩ জন আনসার সদস্য, ২ জন ফায়ারসার্ভিস সদস্য, ১ জন এনএসআই সদস্য, ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ জন সাংবাদিক, ৬৪৭ জন নারী, ৪৬৬ জন শিশু, ৪১৬ জন শিক্ষার্থী, ৮১ জন শিক্ষক, ১৫২৬ জন চালক, ২৬০ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮ জন প্রকৌশলী, ৭ জন আইনজীবী, ৭৭ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ২২ জন চিকিৎসক।

এতে বলা হয়, গত ১ বছরে সংগঠিত এসব দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৮ হাজার ৫৫০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে, যার ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বাস, ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ- কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ২৬ দশমিক ০২ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।

এছাড়া ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দুর্ঘটনায় সংগঠিত যানবাহনের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক, ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বাস সড়কে দুর্ঘটনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ২৩ দশমিক ২২ শতাংশ নসিমন-মাহিন্দ্ৰা-লেগুনা, ২৩ দশমিক ০৩ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ১৯ দশমিক ০৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-লরি সড়কে দুর্ঘটনা বিগত বছরের চেয়ে কমেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ৮৩ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা, ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বিবিধ কারণে, শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেঁছিয়ে এবং শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২০২২ সালের তুলনায় বিদায়ী ২০২৩ সালে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ গাড়ি চাপা, ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেচিয়ে, ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ৩৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, ১৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা কমেছে। এছাড়া বিবিধ কারণে ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুর্ঘটনার ধরণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১ দশমিক ১১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া ও এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে ফিডার রোডে ৫৫ দশমিক ১৯ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এবার আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৯.৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে।

সংবাদ সম্মেলনে এ সময় যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়।

এতে আরও বলা হয়, বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি, এইদিনে ৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছে। ২৬ মার্চ সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, এইদিনে ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে নিহত হয়েছে ৩৭ জুলাই, এইদিনে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত ও ৯৮ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ৪ মার্চ, এইদিনে ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে বেপরোয়া গতি; বিপদজনক অভারটেকিং; রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি; ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল; যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; চালকের অদক্ষতা; যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব; চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার; মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো; রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ; ট্রাফিক আইন অমান্য করা; ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি; সড়কে চাঁদাবাজি; রাস্তার উপর হাট-বাজার; ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালানো; মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা; চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা; সড়কে আলোকসজ্জা না থাকা; রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উচু না থাকা; সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকা এবং দেশব্যাপী নিরাপদ, আধুনিক, স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশগুলো হচ্ছে, করোনার চেয়ে ভয়াবহ মহামারি বিবেচনায় সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার প্রকল্পে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা; নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা; সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে গঠিত সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট শক্তিশালী করা; সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা; দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অংকন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা; গণপরিবহন চালকদের যুগোপযোগী পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা; সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিলে আবেদনের সময়সীমা ৬ মাস নির্ধারণ করা; স্মার্ট গণ-পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া; ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা; উল্টো পথের আলো এবং পথচারীর পারাপার রোধে মহাসড়কের রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উঁচু করা; গণ-পরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণ-পরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।