ধুলা আর ধুলা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিশাল অংশ জুড়ে এমন দমবন্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। দেখার যেন কেউ নেই। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। সামনে এগিয়ে উত্তরায় গেলে দেখা যায় মেট্রো রেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজও চলছে পুরোদমে।
এসব কর্মযজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে—নির্বিঘ্ন ও দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে থাকলে রাস্তায় চোখ আটকে যাবে ধুলার পর্দায়। এ পর্দা ভেদ করে দৃষ্টি হয়তো ১০ বা ২০ হাত পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু চোখের সামনের সব দৃশ্যই-রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশের দোকানপাট, ভবন, বাসা-বাড়ি সবই বিষাক্ত ধুলার আস্তরে ঢাকা।
টঙ্গীর মিতালী ফিলিং স্টেশনের পাশেই সারিবদ্ধ দোকানগুলোর সামনের অংশ ঢেকে রাখা হয়েছে ত্রিপল দিয়ে। আবদুস সালাম নামে একজন দোকানি বললেন, মাসের পর মাস ধরে ধুলার যন্ত্রণা, দোকানের সামানের অংশ ঢেকে রেখেও রক্ষা পাচ্ছি না। দোকানদারি করে হাঁপানির রোগী হয়ে গেছি।
বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইকিউএয়ারের বুধবার বিকেল ৩টার তথ্যানুযায়ী, বায়ুদূষণ নগরীর তালিকায় বিশ্বে ঢাকার অবস্থান ছিল অষ্টম, বায়ুমান সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই) ছিল ১৬৭। এই সময় বিশ্বে সর্বোচ্চ দূষণের নগরী ছিল পাকিস্তানের করাচি। বায়ুমান সূচক ছিল ২০৩। সাভারের দূষণের বায়ুমান সূচক ১৭৩, মানিকগঞ্জে ১৫৮, গাজীপুরের শ্রীপুরে ছিল ১৫৬।
আইকিউএয়ার বলছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকা চলতি সপ্তাহের পুরোটাই ছিল অস্বাস্থ্যকর। আইকিউএয়ার ১৫০ ইউএস একিউআই পর্যন্ত বায়ুমানকে নির্দিষ্ট গ্রুপের জন্য অস্বাস্থ্যকর বলছে। কিন্তু ১৫০ একিউআই পার হলে তা পুরোপুরিই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করে তারা। সে হিসাবে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা অস্বাস্থ্যকর।
বায়ুদূষণ নিরসনে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালত নির্দেশানমূলক রায় দেন। এরপর নানা সময় এ রায় কার্যকর নিয়ে তদারকিমূলক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। উচ্চ আদালত যাদের কারণে রাজধানীতে বায়ুদূষণ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুইবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে ঢাকার যেসব এলাকায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলছে সেসব এলাকা (কাজের স্থান) ঘেরাও করে কাজ করার পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের কারণে ধুলাবালিপ্রবণ এলাকায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দিনে দুইবার পানি ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি মেয়র ও নির্বাহীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
উন্নয়নকাজের এলাকায় প্রয়োজনে দুই বেলা পানি ছিটানোর কথা থাকলেও গতকাল বিআরটি প্রকল্পের ১৩ কিলোমিটার এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, এলাকাবাসী কখনো পানি ছিটাতে দেখেননি।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের অধীনে স্বতন্ত্র লেন তৈরি করা হচ্ছে। এই সংরক্ষিত লেন দিয়ে বেশি ধারণক্ষমতার বাস চলাচল করবে। ঢাকা মহানগর ও গাজীপুর মহানগরের মধ্যে পরিবেশবান্ধব ও দ্রুতগতির গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে হচ্ছে ইমার্জেন্সি লেন
এ প্রকল্পের অধীনে ঢাকার অংশে একটি এবং গাজীপুরের অংশে পাঁচটি ফ্লাইওভার তৈরি করা হবে। প্রকল্পের কাজের কারণে সৃষ্ট ধুলাবালিতে ওই এলাকার জনজীবন অতিষ্ঠ।
টঙ্গী এলাকার সড়কের পাশের দোকানি সামিউল আলম বলেন, আমি কখনো পানি ছিটাতে দেখিনি।
বোর্ডবাজারের বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক মো. আবুল হোসেন বলেন, ধুলা আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মহাসড়কের পাশের দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র, ঘরবাড়ির অবস্থা খুবই শোচনীয়। কয়েক মিনিটেই দোকানে ধুলার স্তর পড়ে যায়। দোকানের মালামাল নষ্ট হচ্ছে। প্রায় দুই বছর ধরে এ অবস্থা চললেও গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে বিপজ্জনক মাত্রায় উড়ছে ধুলা।
ছয়দানা মালেকের বাড়ি এলাকার কাপড়ের দোকান আবরণী স্টোরের মালিক আবদুল হাবিব বেপারী বলেন, ধুলায় ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে। ইট, খোয়া ও বালু মেশানো ধুলা জমে তিন-চার দিনেই কাপড়ের রং নষ্ট হয়ে যায়। কাপড় বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
বোর্ডবাজারের কলমেশ্বর এলাকার বাসিন্দা একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ বণিক বলছিলেন, ধুলার কারণে মহাসড়ক, এমনকি আধা কিলোমিটারের মধ্যে মাস্ক না পরে চলাচল করা দুঃসাধ্য। শরীরে ধুলার স্তর পড়ে যায়। নাক দিয়ে ঢুকে হাঁচি-কাশি দেখা দেয়। ঘরেও ধুলা চলে আসে। বিছানা, তরিতরকারি, রান্না করা খাবার ধুলায় নষ্ট হয়।
ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ঢাকা পরিবহনের চালক আমির হোসেন বলেন, গাড়ির গতি বাড়লে ধুলা ওড়ার গতিও বাড়ে। এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অনেক সময় দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালাতে হয়। যাত্রীরা তো ধুলায় মাখামাখি হয়ই, গাড়িও নষ্ট হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বায়ুমান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, উন্নয়নকাজের ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতি মানা হচ্ছে না। ধুলার জন্য পানি ছিটানোর কথা। কিন্তু তা হয় না। সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির পর মাটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা। তা না করে সড়কেই ফেলে রাখা হয়। মাটি শুকিয়ে ধুলি হয়ে বাতাসে ওড়ে। জনবহুল এলাকায় সড়কের কাজ দ্রুত করার কথা। কিন্তু ঠিকাদার কাজ ফেলে রাখেন।
অধ্যাপক সালাম বলছেন, ঢাকা শহরে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া হয়। এটা আরো ক্ষতিকর। ঝাড়ু দিয়ে রাস্তার ধুলি আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। ঝাড়ু দেওয়া পদ্ধতি বাদ দিতে হবে, প্রয়োজন ডাস্ট কালেক্টর, যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধূলিকণা সংগ্রহ করে নেওয়া হবে। সেটা করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমরা এক বিপজ্জনক দূষণের দিকে এগোচ্ছি।
বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস হোসেন লেন, দ্রুতই সড়কে ধুলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মহসিন বলেন, কিছুদিন থাকে আবার কিছুদিন থাকে না। আমার কাজের এলাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত তেমন ধুলা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর, গাজীপুর জেলার উপপরিচালক আবদুস সালাম সরকার বলেন, ‘বিআরটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বায়ুদূষণ রোধের জন্য প্রকল্পে ব্যয় ধরা আছে। বিপজ্জনক মাত্রায় বায়ু ও শব্দদূষণের অভিযোগ পাওয়ায় বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারদের সতর্ক করা হয়েছে। তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে।