আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে।
শুক্রবার (৫ এপ্রিল) জেনেভায় ৪৭টি সদস্য দেশের ভোটাভুটির মাধ্যমে এই প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বানও জানানো হয়েছে। তবে ইসরায়েল ওই প্রস্তাবকে একটি ‘বিকৃত খসড়া’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে আল-জাজিরা জানিয়েছে, উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ৪৭টি দেশের মধ্যে ২৮টি দেশই ভোট দিয়েছে। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ৬টি দেশ। আর ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ১৩টি দেশ।
ইসরায়েলে বাহিনী প্রায় ছয় মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালাচ্ছে। নির্বিচার এ হামলায় অবরুদ্ধ উপত্যকাটির ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রস্তাব পাসের মধ্য দিয়ে গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে এবারই প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নিল মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্ষদ।
ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি, স্থানান্তর ও অন্য কোনোভাবে না পাঠাতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবে। তাতে বলা হয়েছে, গাজায় নতুন করে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে এই আহ্বান জানানো হচ্ছে। একই সঙ্গে গাজায় গণহত্যার ঝুঁকি নিয়ে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) রুলের কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবে।
এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক শীর্ষ সংস্থাটি প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। তবে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত মিরাভ ইলন শাহার এই প্রস্তাবকে মানবাধিকার পরিষদ এবং জাতিসংঘের জন্য একটি কলঙ্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মানবাধিকার পরিষদকে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি জনগণের প্রতি বিরূপ মনোভব এবং হামাসকে রক্ষা করার অভিযোগ করেছেন।
দৃঢ় শব্দযুক্ত ওই প্রস্তাবটিতে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি, হস্তান্তর এবং পরিবর্তন বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। গাজায় ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিয়ে ইসরায়েল ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগও করা হয়েছে। জোর দিয়ে বলা হয়েছে—গাজায় গণহত্যার একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে বলে গত জানুয়ারিতে রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।
ইসরায়েলের আইনজীবীরা সে সময় গাজায় ইচ্ছাকৃতভাবে মানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য ইসরায়েলি প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেছিলেন।
ইসলামি দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাবটি তুলেছিল পাকিস্তান। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কোন দেশ কোন পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তার একটি চিত্র প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা। এতে দেখা গেছে, পক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, আর্জেন্টিনা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। আর ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ফ্রান্সের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের দপ্তরে প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটিতে উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ডে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম মোহাম্মদ খারাইশি। প্রস্তাবটি নিয়ে ভোটের আগে তিনি বলেন, ‘এই গণহত্যা বন্ধে আপনাদের সবার জেগে ওঠা প্রয়োজন। এটা এমন এক গণহত্যা, যেটা টেলিভিশনের পর্দায় পুরো পৃথিবী দেখছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবে এর কার্যকারিতা সেভাবে নেই।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গাজায় ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাতজন ত্রাণকর্মী নিহতের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন।
ইসরায়েলকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে এসেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে এই প্রথম সহায়তা ও অস্ত্র বন্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন তিনি। এতে ছয় মাস ধরে চলা যুদ্ধে পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
হোয়াইট হাউস বলেছে, বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে টেলিফোনে ৩০ মিনিট আলোচনা হয়েছে। বাইডেন নেতানিয়াহুকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখতে, মানুষের দুর্দশা কমাতে ও ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েলকে বিশেষ, সুনির্দিষ্ট ও পরিমিত পদক্ষেপ ঘোষণা করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসরায়েল এসব ক্ষেত্রে কতটা পদক্ষেপ নিয়েছে, তার ওপর মার্কিন নীতি নির্ভর করছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে বেশির ভাগ সময় ইসরায়েলের কূটনৈতিক ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ইসরায়েল ও গাজায় যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ নীতিগত কোনো পরিবর্তন আনবে কি না, সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাননি হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি। তিনি বলেন, শিগগিরই ইসরায়েল তাদের গৃহীত পদক্ষেপের ঘোষণা দেবে বলে ওয়াশিংটন আশা করছে।
হোয়াইট হাউস আরও বলেছে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপে বাইডেন গাজায় মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়নে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।