রংপুর জেলা প্রতিনিধি :
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আলফি শাহরিয়ার মাহিম নামের এক ১৬ বছরের কিশোরকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তারের পর ১২ দিন ধরে রংপুর কারাগারে বন্দী রয়েছে সে। পুলিশ মামলায় তার বয়স উল্লেখ করেছে ১৯ বছর।
বুধবার (৩১ জুলাই) ভুক্তভোগীর বোন সানজানা আখতার স্নেহা ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
আলফি শাহরিয়ার মাহিম গত বছর রংপুর নগরীর আশরতপুর চকবাজার এলাকার সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। বর্তমানে তিনি রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল চকবাজার এলাকার বাসিন্দা এবং পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
মাহিমের বোন সানজানা আখতার ফেসবুকে লেখেন, ১৮ জুলাই সে (আলফি শাহরিয়ার মাহিম) কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলে জানতে পারে পরীক্ষা স্থগিত। তখন বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের টিয়ারশেলে বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা ১৮ তারিখ আনুমানিক বিকেল ৪টায় ওর বন্ধুদের থেকে জানতে পারি, তার পায়ে রাবার বুলেট লেগেছে। সেখানকার স্থানীয় লোকজন কোনো হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। এ তথ্য পেয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত সব হাসপাতাল-ক্লিনিক খুঁজেও যখন পাচ্ছিলাম না, তখন বাবার কাছে একটা কল আসে। তারা জানায়, আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে। জানাজানি করবেন না। তাতে ছেলের ক্ষতি হবে। তাকে আগামীকাল (১৯ জুলাই) সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু পরদিন ১৯ জুলাই সকালে আমরা খোঁজ নিলে তারা অস্বীকার করে বলে, তাদের কাছে এই নামে কেউ নেই। এরপর আনুমানিক বিকেল সাড়ে চারটায় কোর্ট থেকে কল আসে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পোস্টে তিনি আরও লেখেন, আমরা কোর্ট থেকে নথিপত্র নিয়ে জানলাম, তাকে (আলফি) আবু সাইদ ভাইয়ের হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। সেদিন থেকে বার বার কারাগারের দরজা থেকে ফিরে এসেছি। একটিবার দেখা তো দূর; তার কণ্ঠও শুনতে দেয়নি কেউ। মেট্রোপলিটন কোর্ট তার মামলা কিছুতেই শিশু আদালতে (জুভেনাইল কোর্ট) দিতে চায়নি। অনেক চেষ্টা করে গত ৩০ জুলাই শিশু কোর্টে নেওয়া হলে ডেট দেয় আগামী ৪ আগস্ট। ৪ তারিখ কী রায় দেবে আমার জানা নেই। তবে আমি আমার ভাইকে ফিরে চাই। বেকসুর খালাস দেওয়া হোক এটা চাই।
সানজানা আখতার বলেছেন, যে ছেলেটা লিগ্যাল ডকুমেন্টস অনুযায়ী শিশু; তাকে তারা কোন হিসাবে এভাবে হ্যারাস (হয়রানি) করাচ্ছে? সব থেকে বড় কথা তার গায়ে কলেজ ড্রেস ছিল। আইডি কার্ড ছিল। সে পুলিশদের ইনস্টিটিউটেরই ছাত্র। এক্ষেত্রে কি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সহপাঠী, আইনজীবী কারও কিছুই করার নাই? আমার ভাইকে কোন লজিকে তারা আটকে রেখেছে, দেখাও করতে দিচ্ছে না!
গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিকেলে আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক।
মাহিমের বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, পুলিশ কমিশনার আমাকে ডেকেছিলেন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ছেলের সঙ্গে কারাগার থেকে কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ কমিশনার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন মাহিমকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এজন্য আজকে কোর্টে জামিন শুনানির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
রংপুরের আদালত সূত্রে জানা গেছে, ওই কিশোরকে ১৯ জুলাই আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রংপুর মেট্রোপলিটনের তাজহাট আমলি আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।
এদিকে আবু সাঈদের মৃত্যু ঘটনায় করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাজহাট থানার এসআই জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ওইদিন (১৭ জুলাই) আমাদের তাজহাট থানায় যখন আগুন দেয়, তখন সে পিকেটিং করছিল। ওই সময় সে বিজিবির হাতে ধরা পড়ে।
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ঘটনার দিন তো পুরো রংপুর উত্তপ্ত। পরে আলফি আমাদের হেফাজতে ছিল। পরদিন সকালে তাকে এই মামলায় আদালতে চালান দেওয়া হয়। কিন্তু পরদিনও উত্তপ্ত ছিল রংপুর। এ কারণে ওই সময় তার বয়স যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, আইন অনুযায়ী তো তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি আমরা রাখতেও পারি না। এই কারণে তাড়াহুড়ো করে তাকে চালান দেওয়া হয়। যাই হোক এ ঘটনায় তার মা-বাবাকে পুলিশ কমিশনার স্যার ডেকে আশ্বস্ত করেছেন, তার বয়স কম। সম্ভবত শিগগিরই তার জামিন হবে। তাকে চার্জশিট থেকেও অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলেছেন স্যার।
এ বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আবু মারুফ হোসেন (অপরাধ) বলেন, ১৮ জুলাই যখন থানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয় তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জিন্সের প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় আটক হয় মাহিম। পরে তাকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়।
উপ-পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, যেহেতু ১৮ ও ১৯ তারিখে সংঘাত-সংঘর্ষ নিয়ে পুরো ফোর্স ব্যস্ত ছিল, সে কারণে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। মূলত ২০ জুলাই থেকে আমরা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে গ্রেফতার করেছি। বিষয়টি জানামাত্র পুলিশ কমিশনার মহোদয় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যেহেতু মাহিম ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না, আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল মাত্র, জামিনের মাধ্যমে তাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
মাহিমের আইনজীবী বাহারুল ইসলাম বলেন, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর বিচার কখনো পূর্ণবয়স্ক আসামির সঙ্গে হওয়ার সুযোগ নেই। শিশুদের মামলার বিচার হবে শিশু আদালতে। আগামী ৪ আগস্ট তার জামিন শুনানি।
রংপুর বারের আইনজীবী রায়হান কবীর বলেন, যে ছেলেটি বলছে, তার বয়স ১৬ বছর ১০ মাস; স্বপক্ষে কাগজ দেখাচ্ছে তার পরিবার। তাকে কেন মামলায় ১৮ বছর দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলো? একবার থানা থেকে যোগাযোগে করা হলো। পরে বলা হলো আমাদের কাছে নেই। পরে পাঠানো হলো কারাগারে। এটা বেআইনি।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় এনে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। জবাবদিহিতা না থাকায় আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের পূর্ণবয়স্ক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। এতে শিশুরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।