নিজস্ব প্রতিবেদক :
ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ-সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত করা উচিত।
শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিকেলে জাতীয় সংসদের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘বিশেষ অধিবেশনে’ ভাষণ দানকালে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। এটাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে দেওয়া আবদুল হামিদের শেষ ভাষণ। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনও দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সবার সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁওস্থ সংসদ ভবনে শুরু হয়। গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর হয়। স্বাধীনতার এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রকামী যে কোনো দেশের জন্য গর্বের। এ সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষরকারী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি স্বাক্ষর করি ৭১ নম্বরে। এ সংবিধানের আওতায় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। এর ঠিক এক মাস পর একই বছরের ৭ এপ্রিল প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। আজ মহান জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সময়ের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা সব সময় মসৃণ ছিল না। গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা যখনই বাধাগ্রস্ত হয়েছে তখনই এর একটি প্রভাব পড়েছে জাতীয় সংসদের ওপর। বিগত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারই নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বর্তমানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কোনো গোষ্ঠী বা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, জাতির বীর ও সাহসী সূর্যসন্তানরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এই দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আমি আজ দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন, সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে, এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে আমাদের আছে একটি অনন্য পরিচয়। সে পরিচয়কে আমাদের ঐকান্তিকতা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে সমুন্নত রাখতে হবে। দেশের উন্নয়নে আমাদের চিন্তা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে সুগভীর ঐক্য থাকবে জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে। হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয়; আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি পরিচয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। আর উত্থান হয়েছে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে হয়েছিল আমার রাজনীতির হাতেখড়ি ও প্রথম উত্থান আর ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় উত্থান ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই এবং তার উদ্যোগেই।’তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ আর তার দূরদর্শিতার কারণেই আমি আজকে এই অবস্থানে পৌঁছেছি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আমি বেশি গর্ববোধ করি।
সংসদে দেওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সেদিন আমাকে ডেপুটি স্পিকারের পদমর্যাদা না দিলে হয়ত বা কিশোরগঞ্জ ঘিরে আমার রাজনীতি আবর্তিত হতো। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি তখন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র। পরিচয় থেকেই বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শের অনুসারী হয়ে যাই।
আবদুল হামিদ বলেন, মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো অনেক সময় তিনি নিজেও ডেকে পাঠাতেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমার একমাত্র ধ্যান-ধারণা তাঁর নীতি, আদর্শ ও নির্দেশনাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় বিষয় ছিল।
রাষ্ট্রপতি স্মৃতিচারণ করেন, শুধু আমি কেন ওই সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক যুবকের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একমাত্র আদর্শ; যার পিঠে একবার বঙ্গবন্ধুর হাত পড়েছে বা স্নেহের ছোঁয়া লেগেছে তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৪ এপ্রিল। রাষ্ট্রপতি হামিদ আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ডেপুটি স্পিকার এবং স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন।
আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়নকেও সমান গুরুত্ব দিতেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেন।
তিনি ৫০ বছর আগে জাতীয় সংসদের প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে দেওয়া বক্তব্যের স্মৃতিচারণ করেন।
রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-আপনার কর্তব্যপালনে সংসদের সদস্যবৃন্দ সবসময় আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। আমি আশা করব, যে ট্র্যাডিশন পার্লামেন্টারি সিস্টেমে আছে, আপনি সেটার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিরপেক্ষভাবে আপনার কার্য পরিচালনা করবেন। আমাদের কাছ থেকে আপনি সাহায্য ও সহযোগিতা পাবেন। এই সংসদের মর্যাদা যাতে রক্ষা পায়, সেদিকে আপনি খেয়াল রাখবেন, কারণ আমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, সে ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, দুনিয়ার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে যে সব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি সংসদীয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এখানে কোন দল বা মতের নয়- এখানে এই দেখব যে, প্রত্যেক সদস্য যেন যাঁর যে অধিকার আছে, সে অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। সেদিকে আপনিও খেয়াল রাখবেন বলে আমি আশা পোষণ করি।
তিনি বলেন, এ সম্পর্কে আপনি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। পার্লামেন্টারি ট্রেডিশন পুরোপুরি ফলো করতে আমরা চেষ্টা করব।
রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, গণপরিষদে কোনো বিরোধী দল না থাকলেও সংসদ অধিবেশন হতো প্রাণবন্ত। যুক্তিতর্ক ও মতামত উপস্থাপন ছিল খুবই আকর্ষণীয়। তিনি বলেন, ন্যাপ থেকে নির্বাচিত একমাত্র গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সুযোগ চাইলে সবসময়ই সুযোগ পেতেন। স্পিকার মাঝে মধ্যে তাঁকে মাইক দিতে না চাইলেও বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘ওকে সুযোগ দেন, বিরোধী পক্ষের কথা আগে শুনতে হবে।’
সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়, দল-মত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব, এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারবে।’
বঙ্গবন্ধু সংসদ কার্যক্রমের পাশাপাশি দলীয় শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দিতেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রথম অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমি মাননীয় সংসদ সদস্যদের আর একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, কোনো প্রস্তাব আনার আগে পার্টিতে তা আলোচনা করে তারপর উপস্থাপন করবেন। তা না হলে এর দ্বারা পার্টির শৃঙ্খলা নষ্ট হবে।
আবদুল হামিদ বলেন, সংসদ সদস্যদের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ সবকিছুর খবর রাখতেন বঙ্গবন্ধু এবং প্রয়োজনে তাদের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতেন।
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর শিষ্টাচার ও পরমত সহিষ্ণুতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার অনেক সময় বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না।
রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজনৈতিক মতাদর্শের যত অমিলই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু বিরোধী দলের নেতাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। তিনি বলেন, আসলে রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও পরমত সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই।