নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগে যারা মনে করত আমরা শুধু হাত পেতে চলব, এখন তারা আর সেটা মনে করে না। এখন আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিই, কারো কাছে হাত পাতি না। তার সুদসহ ফেরত দিই। আগে ভাবনাটা এমন ছিল যে আমরা ভিক্ষা নিচ্ছি।
বুধবার (৫ জুলাই) দুপুরে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের একটা বদনাম দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। আজ আমরা সেটা করতে সক্ষম হয়েছি। এই একটা সিদ্ধান্ত আমি মনে করি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি…আগে যারা মনে করতো এই দেশ শুধু হাত পেতে চলবে, তারাও কিন্তু এখন সেটি মনে করে না। এটা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলো কানাডার আদালতে, সেখানে সব অভিযোগ ভুয়া ও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিলো।
সরকারপ্রধান বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশকে উন্নত করতে চেয়েছিলেন, তার সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ২১ বছর পর সরকার গঠন করার সুযোগ পাই আমরা। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীসহ প্রতিটি বাহিনী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যাতে উন্নত হয় তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ আমি হাতে নিয়েছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কারণ শান্তি রক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কাজ করে, পুলিশ বাহিনী কাজ করে, তারা যেন অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে, কোনোভাবেই যেন পিছিয়ে না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশের প্রতিটি সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার হয়েছে। আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৮.৭ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে ধাবিত হচ্ছি। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমাদের নিজেদের অর্থে বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। ফলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও মর্যাদা বহুলাংশে বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি বাহিনী সাধারণ মানুষের পাশে আছে। শুধু দেশে নয়, শান্তিরক্ষা মিশনেও যারা কাজ করে তাদের মাঝে সবচেয়ে মানবিক গুণ হলো, যে দেশে তারা যায় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সেবা দিয়ে থাকে। এজন্য প্রত্যেকের কাছে একটা মর্যাদা পায়। আমি খুব গর্ববোধ করি, কারণ যে দেশে আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী কাজ করে সে দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান যখন প্রশংসা করে তখন গর্ববোধ হয়। আমরা সম্মান পাচ্ছি এটাকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিলাম। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় দেশ যেন অন্তত এক ধাপ এগিয়ে যায় সেটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। এজন্য আমি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাই। আজকের বাংলাদেশ আমাদের সেই রূপকল্প বাস্তবায়ন করে আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন করছি, তখন কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি পেশাদার, প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি গড়ে তোলেন। তিনি কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি আমরা। ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি।
একদিনে ১০০ সেতু এবং একদিনে ১০০ সড়ক উদ্বোধনকে বিশ্বে বিরল উদাহরণ আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশের সব ভূমিহীন-গৃহহীনকে বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছি। আমরা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছি।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই যেই দেশে আমাদের দেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছে, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান যখন আমাদের বাহিনীর প্রশংসা করে তখন সত্যিই আমার গর্বে বুক ভরে যায়। এই যে আমরা সম্মান পাচ্ছি, সেটিকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীসহ প্রতিটি বাহিনী, প্রতিষ্ঠান যেন উন্নত হয় সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিলাম আমি। আমার লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কেননা, শান্তি রক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী কাজ করে। তারা যেন অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে, কখনো কোনোভাবে পিছিয়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে আমি নানা পদক্ষেপ নেই।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। হ্যাঁ, আমাদের একটা অন্ধকার যুগ গেছে। কিন্তু যখন থেকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, তখন থেকে যে উন্নয়নের ধারা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ অনেক পাল্টে গেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানবশক্তি গড়ে তোলার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে কৃষি স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল সিস্টেম আমরা ব্যবহার করে আমাদের জনগণকে আমরা দক্ষ সমাজ অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট জনশক্তি, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট জনগণ হবে। সেভাবেই আমরা দেশকে গড়ে তুলবো। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট। সব প্রতিষ্ঠানকে আমরা সেভাবেই গড়ে তুলছি।
তিনি বলেন, ঘোষণা দিয়েছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ, সেটা আমরা করে দেখিয়েছি। প্রতি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। বাংলাদেশ আর কারও কাছে হাত পেতে চলবে না, সেভাবে আমরা দেশকে গড়ে তুলেছি।
কোভিড ও যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে আবারও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। কোভিড ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দুই বছর পর ২০২৬-এ আমরা বাস্তবায়ন করবো। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১ থেকে ৪১ প্রণয়ন করে আমরা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আমরা সেই কাজ শুরু করেছি। তাছাড়া জাতিসংঘ এমডিজি বাস্তবায়নে আমরা সফলতার সঙ্গে করছি। অর্থাৎ সাসটেইনেবল গোল সেটাও আমরা কিন্তু বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। আমরা খুব পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছি। সুতরাং আমরা এই অর্জনগুলো সুষ্ঠুভাবে করতে পারবো। বাংলাদেশ যেন আর পিছিয়ে না যায় সেভাবে আমরা দেশকে গড়ে তুলতে চাই।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করেছি। আমরা পদ্মাপারের মানুষ সবসময় অবহেলিত ছিলাম। সেখানে আমরা একটা সেনানিবাস করেছি। তাছাড়া আরও দুটি দুটি সেনানিবাস সিলেটে ও রামুতে আমরা করেছি। অন্যান্য আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। যাতে আমাদের দক্ষতা আরও বাড়ে এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজ আমরা করতে পারি।
সরকারপ্রধান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে গার্ড সদস্যদের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে গার্ড ভাতা প্রচলন করে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরও সহজ করতে সেনানিবাসে একটি ইনডোর পিস্তল ফায়ারিং রেঞ্জ স্থাপন করা হয়েছে। রেজিমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০১৩ সালে জনবল বৃদ্ধিসহ একটি স্বতন্ত্র রেজিমেন্টে রূপান্তরিত করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় এই রেজিমেন্টে আর্মাড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) যুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা একটি ১৪ তলা ভবন নির্মাণ করে দিয়েছি।
ভবিষ্যতেও গার্ডসদের কল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, গণভবনে সৈনিক আবাস ও আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে এ বছর আমি পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে ৫.৫ একর জমি পিজিআর’র জন্য বরাদ্দ করেছি। এখানে পরিকল্পিত পার্ক হবে। যেখানে শিশু পার্ক থেকে সব ধরনের সুযোগ থাকবে। কেউ যদি কোনও অনুষ্ঠান করতে চায়, সেই জায়গাও থাকবে।
এসময় রেজিমেন্টের প্রতিটি সদস্যের সাহসিকতা, সততা, আন্তরিকতা ও পেশাগত দক্ষতা এবং কর্তব্য নিষ্ঠায় নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।