নিজস্ব প্রতিবেদক :
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে ব্যাংকিং খাতে কিছু সংস্কার হওয়ায় অর্থপাচারে প্রতিরোধক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে অর্থপাচার বন্ধ না হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উন্নত বিশ্বে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার মাত্র ১ শতাংশ ফেরত আসে।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচার হওয়া টাকা দেশের ফেরত আনা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কার্যকর করতে দুদক সংস্কার কমিশনে সহযোগিতা করছে টিআইবি। সংস্কার কমিশনে যুক্ত হয়ে সরকারের থেকে কোনো অনুদান নেইনি।
অর্থপাচার কমেছে কি না জানতে চাইলে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিছুটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাত ছিল অর্থপাচারের অন্যতম খাত। সেখানে কিছু সংস্কার হয়েছে, যে কারণে আগে ঢালাওভাবে এখানে জালায়াতির সুযোগ ছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। যে অ্যাক্টররা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছে, কিংবা দেশের বাইরে আছে। তাদের সেই ভূমিকা নেই বললেই চলে। যদিও নতুন অ্যাক্টরের জন্ম হয়নি বা হচ্ছে না, এটা আমরা বলতে পারবো না।
ব্যাংক খাতে আরও অনেক বেশি সংস্কারের প্রয়োজন আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ খাতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়েছে-পরিবর্তন হয়েছে। যে পদ্ধতি মোটা দাগে বিশাল অর্থপাচার হতো সেটা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
যত অর্থ ও প্রচেষ্টা ব্যবহার করা হচ্ছে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য, তার চেয়ে বেশি অর্থ ও প্রচেষ্টা ব্যবহার করা প্রয়োজন অর্থপাচার প্রতিরোধ করার জন্য।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ থেকেও অর্থপাচার হতো জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসতো। এর মাধ্যমে টাকা পাচার হতো। সেটাও মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। মিস ইনভয়েসিং বা আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের চালান জালিয়াতির মাধ্যমে যে অর্থপাচার হয়; সেটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, সেটা বলতে পারবো না।
দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থপাচার যেন না হয় সেটিতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
আমদানি এবং রফতানি বাণিজ্যে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থপাচার হয় জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের সিংহভাগ অর্থপাচারের মাধ্যম ছিল এটা। সেটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে আমি বলতে পারবো না। কারণ সেখানে বাস্তব সংস্কার এখন পর্যন্ত হয় নাই। কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আমাদের সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ছিল। সেগুলো যদি বাস্তবায়িত হলে আস্তে আস্তে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অর্থপাচার যেন না হয় সেটিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিরোধ করা আমাদের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত, আমাদের প্রাধান্য উচিত। যেন পাচার না হয়। যেটা একবার পাচার হয়ে যায়, সেই টাকাটা ফেরত আনাটা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। পুরো বিশ্বে ১ ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয় প্রতিমাসে, তার ১ শতাংশ ফেরত আনা যায়, তাও সেটি ফেরত আনতে ৭ থেকে ৮ বছর লেগে যায়। ফ্রিজ হওয়ার মানে কিন্তু আমরা টাকাটা পেয়ে যাবো, সেটা কিন্তু না। টাকাটা যে বাংলাদেশ থেকে গেছে ওখানকার আদালতে সেটাকে প্রমাণ করতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ফেরত আনা এটা খুবই কঠিন ও জটিল এবং দীর্ঘ মেয়াদি। খুব সহজে পাওয়া সম্ভব হবে না। হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রতি বছর আমাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সহায়তা বছর যে পরিমাণ আসতো তার দ্বিগুণ অর্থ এ দেশ থেকে পাচার হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করে তাদের পাচার করা অর্থ যদি বিদেশে যাওয়ার কোনও সুযোগ না থাকতো তাহলে তারা লন্ডন, কানাডা বা দুবাইতে টাকা লগ্নি করতে পারতো না। বাইরে যাওয়ার সুযোগটাকে আমাদের বন্ধ করতে হবে। সেই বন্ধ করার হাতিয়ার আমাদের কাছে কিছুটা আছে, সেগুলোকে আরও শানিত করতে হবে। যে আইনগুলো আছে সেগুলোকে আরও জোরালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমাদের এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ার ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ান বলেন, গণমাধ্যমকে দমন, অবাধ তথ্য প্রবাহ বন্ধ করা এবং সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে হুমকি প্রদর্শন গোপনীয়তার সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়। আর গোপনীয়তার সংস্কৃতি ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সত্য তথ্য তুলে ধরেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, সেজন্য তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। সুশীল সমাজের কাছে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনও মাধ্যম নেই, তবে আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলা। আমরা আরও যেটা করি সেটি হলো, এসব ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকি। সহিংস পরিবেশে কখনোই গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন করা যায় না।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ান বলেন, সহিংস পরিবেশ ক্ষমতার অপব্যবহার পুনর্বহালে সহায়তা করে। তাই এটি প্রায় সব দেশেই গুরুতর উদ্বেগের যেখানে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষ এই ধরনের সহিংসতার সম্মুখীন হয়।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর দুর্নীতির সুচক প্রকাশ করি যদিও সব সেক্টরের বিষয় সেখানে পুরোপুরি আসে না। এটা সত্য যে বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতির সূচক বাংলাদেশে কমেছে। তবে প্রতিফলন স্বরূপ গতবছর আগস্টে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটতে দেখা গেছে। তারপরে কি দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, স্পষ্টতই না। তবে কি বেড়েছে? এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশে সংস্কার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। কিছু কাজ শুরু হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের পথে আছে। এই কাজগুলো কিন্তু দুর্নীতির সূচক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। যেসব দেশ তাদের সূচকে উন্নতি করে, আমরা তাদের বলি যেসব ক্ষমতাবান লোক দুর্নীতিতে জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় এনে সুশাসন নিশ্চিত করতে।
ফ্রাঁসোয়া বলেন, আমরা সবসময় ক্ষমতার সঙ্গে এবং ক্ষমতার বিপক্ষে কাজ করেছি। এর অর্থ হচ্ছে আমরা অংশগ্রহণ করছি আবার সমালোচনাও করছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী হয়েছে, আমাদেরও সমালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কোনও সরকার নেই যারা আমাদের সমালোচনা করেনি। আমি মনে করি আগামি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে সেই সরকারও টিআইবি’র কর্মকাণ্ডে অখুশি হবে।
তিনি বলেন, যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে জিডিপি’র সঙ্গে তুলনা করলে দেখবেন জনগণের টাকা চুরি হয়েছে, জনগণকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে। ঘুষের পেছনে জনগণের যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটার হিসাব কখনও পাচার করা অর্থের সঙ্গে যথাযথভাবে তুলনা করা যাবে না। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যে ১৬ বিলিয়ন ডলার গায়েব হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। এই অর্থপাচার না করলে অনেক সুযোগ তৈরি করা যেতো বাংলাদেশে। এই অর্থ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, অবকাঠামো, জরুরি প্রয়োজনীয় সেবার জন্য ব্যয় করা যেতো। এই অর্থ চুরি না হলে বাংলাদেশের জিডিপি আরও অনেক বেশি হতো।
ফ্রাঁসোয়া বলেন, আমাদের মতো বৈশ্বিক সুশীল সমাজ বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশংসা করছে। তারা বাংলাদেশের দিকে নজর রাখছে। আমরা দেখছি যে বাংলাদেশ সরকার সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন করা হয়েছে। সংস্কার সুপারিশের অনেক কিছুই টিআইবি জানিয়েছে। আমাদের স্পষ্ট পরামর্শ হচ্ছে- এই সংস্কারগুলো টেকসই হতে হবে।