Dhaka শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অভ্যুত্থানে প্রাণহানি, ১৫ মাস পর ‘দোষ স্বীকার’ হাসিনার

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে প্রাণহানির ঘটনায় ‘দোষ স্বীকার করেছেন’ পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনটি দাবি করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার। ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বও দায়ী’, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনপর্বে হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রথম বার ‘দোষ স্বীকার’ করলেন হাসিনা- শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণবিক্ষোভের জেরে ক্ষমতা হারানোর ১৫ মাস পর প্রথম বার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দায় এড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এ বার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কার্যত দোষ স্বীকার করলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকা ছেড়ে দিল্লিতে চলে যান হাসিনা। সেই থেকে ভারতেই ‘অজ্ঞাতবাসে’ রয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই চলতি সপ্তাহের ইমেলে তিন সংবাদমাধ্যম- রয়টার্স, এএফপি এবং দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গত বছরের জুলাই-অগস্টের আন্দোলনপর্বে বিপুল প্রাণহানির দায় চাপিয়েছিলেন পুলিশ ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাঁধে। নাম না করে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন ‘বিদেশি চক্রান্ত’ এবং আন্দোলনকারীদের একাংশের দিকেও।

কিন্তু বৃহস্পতিবার সুর বদলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোষের কথাও কবুল করেছেন হাসিনা। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, আপনি কি রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত হিংসার জন্য দায় স্বীকার করেন? জবাবে তিনি বলেন, দেশের নেত্রী হিসেবে, আমি চূড়ান্ত ভাবে নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করি। হত্যাকাণ্ডের জন্য আইনরক্ষক বাহিনীকে নিশানা করে তিনি বলেন, আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলাম, এই অভিযোগ মৌলিক ভাবে ভুল। প্রাণহানি বা আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতির উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে ইমেইল মারফত দেওয়া ওই লিখিত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।

২০১৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর বয়কট সত্ত্বেও ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’, ২০১৮ সালে ‘নিশিরাতের নির্বাচন’ ও ২০২৪ সালে ‘আমি-ডামি নির্বাচনে অভিযুক্ত হাসিনা দাবি করেন, আসন্ন নির্বাচন হলে সেটা বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে না, যদি তার দল অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়।

সম্প্রতি বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমে ইমেইল মারফত দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানালেও এবার সুর পাল্টে তিনি বলছেন, এমন কোনো আহ্বান তিনি জানাননি।

গত বছরের জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের দমনে মাঠে নামালে সহিংসতার শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্নিগর্ভ হলে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাসিনার সরকার। একইভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তাদের উন্মত্ততায় রাজপথে বয়ে যায় রক্তের নদী। এক পর্যায়ে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। তীব্র জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা আর টিকতে পারেননি। পালিয়ে যান ভারতে। তার আগে-পরে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মী। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও গাঢাকা দেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে এক হাজার চারশ’র বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে মারা যান। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। অনেকের দুই চোখ, কারো কারো এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে র‌্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, এই হত্যাকাণ্ডসহ দমন-পীড়নে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এ বছরের জুলাইতে বিবিসিতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যেখানে শেখ হাসিনার কথোপকথনের একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।

বিবিসির যাচাই করা ওই রেকর্ডিং অনুসারে, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তারা (এসব বাহিনীর সদস্যরা) যেখানেই তাদের (আন্দোলনকারী) পাবে, তারা গুলি করবে।

ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে এবং এর বিচার চলছে।

সেই হত্যাকাণ্ডের দায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মীরা দ্রুত পরিবর্তিত এবং সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন। সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের আচরণে নিঃসন্দেহে ভুল হয়েছিল, তবে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল স্বভাবতই সামঞ্জস্যপূর্ণ, সৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত এবং প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে নেওয়া।’

শেখ হাসিনার শাসনামলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার চলাকালে আসামিপক্ষের সাক্ষী গুম হওয়া, স্কাইপি কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ক্ষমতাচ্যুত এ শাসক এখনকার আদালতের বিচারের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলেছেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়টি আগে থেকেই নির্ধারিত। যখন তা ঘোষণা করা হবে, আমি অবাক হব না। কিন্তু এই আইসিটি আসলে এক প্রহসনমূলক আদালত, যা আমার রাজনৈতিক শত্রুরা নিয়ন্ত্রণ করছে—যাদের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ধ্বংস করা। মৃত্যুদণ্ডের দাবি আসলে সেই একই হত্যাপ্রবণ লক্ষ্যকেই পরিবেশন করে।

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলেও শেখ হাসিনা এখন বলছেন, ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি জমা দিতে হয়। আমি কখনো এমন কোনো চিঠিতে সই করিনি, রাষ্ট্রপতিও কোনো পদত্যাগপত্র পাননি।’

কেবল ভারতের প্রশ্রয় ও সমর্থনে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করা শেখ হাসিনা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। আমি নিশ্চিত নই যে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন যদি হয়ও, আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে তা বৈধ হবে না।

আগের সাক্ষাৎকারগুলোয় প্রকাশিত নির্বাচন বর্জনের আহ্বানের সুর পাল্টে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্পষ্ট করে বলি: আমি বর্জনের আহ্বান জানাইনি। আমি শুধু বলেছিলাম, যদি আওয়ামী লীগকে ভোটে অংশ নিতে না দেওয়া হয়, তাহলে কোটি কোটি সমর্থক ভোট দেবে না, কারণ তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন করার সুযোগ পাচ্ছে না।’

বাংলাদেশে না ফেরার কারণ হিসেবে ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি’কে দায়ী করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ইউনূস তার মন্ত্রিসভায় কিছু ‘উগ্রপন্থিকে’ নিয়োগ দিয়েছেন, এই ঘটনাটা তাদের (উগ্রপন্থিদের) জন্য একধরনের উৎসাহের বার্তা দিচ্ছে এবং নিঃসন্দেহে তাদের বাস্তব সহায়তাও দিচ্ছে।

আবহাওয়া

রাজশাহীতে ট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে তিন যুবক নিহত

অভ্যুত্থানে প্রাণহানি, ১৫ মাস পর ‘দোষ স্বীকার’ হাসিনার

প্রকাশের সময় : ০৮:২৯:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে প্রাণহানির ঘটনায় ‘দোষ স্বীকার করেছেন’ পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনটি দাবি করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার। ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বও দায়ী’, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনপর্বে হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রথম বার ‘দোষ স্বীকার’ করলেন হাসিনা- শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণবিক্ষোভের জেরে ক্ষমতা হারানোর ১৫ মাস পর প্রথম বার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দায় এড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এ বার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কার্যত দোষ স্বীকার করলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকা ছেড়ে দিল্লিতে চলে যান হাসিনা। সেই থেকে ভারতেই ‘অজ্ঞাতবাসে’ রয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই চলতি সপ্তাহের ইমেলে তিন সংবাদমাধ্যম- রয়টার্স, এএফপি এবং দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গত বছরের জুলাই-অগস্টের আন্দোলনপর্বে বিপুল প্রাণহানির দায় চাপিয়েছিলেন পুলিশ ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাঁধে। নাম না করে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন ‘বিদেশি চক্রান্ত’ এবং আন্দোলনকারীদের একাংশের দিকেও।

কিন্তু বৃহস্পতিবার সুর বদলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোষের কথাও কবুল করেছেন হাসিনা। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, আপনি কি রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত হিংসার জন্য দায় স্বীকার করেন? জবাবে তিনি বলেন, দেশের নেত্রী হিসেবে, আমি চূড়ান্ত ভাবে নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করি। হত্যাকাণ্ডের জন্য আইনরক্ষক বাহিনীকে নিশানা করে তিনি বলেন, আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলাম, এই অভিযোগ মৌলিক ভাবে ভুল। প্রাণহানি বা আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতির উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে ইমেইল মারফত দেওয়া ওই লিখিত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।

২০১৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর বয়কট সত্ত্বেও ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’, ২০১৮ সালে ‘নিশিরাতের নির্বাচন’ ও ২০২৪ সালে ‘আমি-ডামি নির্বাচনে অভিযুক্ত হাসিনা দাবি করেন, আসন্ন নির্বাচন হলে সেটা বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হবে না, যদি তার দল অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়।

সম্প্রতি বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমে ইমেইল মারফত দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানালেও এবার সুর পাল্টে তিনি বলছেন, এমন কোনো আহ্বান তিনি জানাননি।

গত বছরের জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের দমনে মাঠে নামালে সহিংসতার শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্নিগর্ভ হলে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাসিনার সরকার। একইভাবে লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তাদের উন্মত্ততায় রাজপথে বয়ে যায় রক্তের নদী। এক পর্যায়ে আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। তীব্র জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা আর টিকতে পারেননি। পালিয়ে যান ভারতে। তার আগে-পরে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মী। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও গাঢাকা দেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে এক হাজার চারশ’র বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে মারা যান। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। অনেকের দুই চোখ, কারো কারো এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে র‌্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, এই হত্যাকাণ্ডসহ দমন-পীড়নে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এ বছরের জুলাইতে বিবিসিতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যেখানে শেখ হাসিনার কথোপকথনের একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।

বিবিসির যাচাই করা ওই রেকর্ডিং অনুসারে, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তারা (এসব বাহিনীর সদস্যরা) যেখানেই তাদের (আন্দোলনকারী) পাবে, তারা গুলি করবে।

ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে এবং এর বিচার চলছে।

সেই হত্যাকাণ্ডের দায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মীরা দ্রুত পরিবর্তিত এবং সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন। সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের আচরণে নিঃসন্দেহে ভুল হয়েছিল, তবে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল স্বভাবতই সামঞ্জস্যপূর্ণ, সৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত এবং প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে নেওয়া।’

শেখ হাসিনার শাসনামলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার চলাকালে আসামিপক্ষের সাক্ষী গুম হওয়া, স্কাইপি কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ক্ষমতাচ্যুত এ শাসক এখনকার আদালতের বিচারের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলেছেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়টি আগে থেকেই নির্ধারিত। যখন তা ঘোষণা করা হবে, আমি অবাক হব না। কিন্তু এই আইসিটি আসলে এক প্রহসনমূলক আদালত, যা আমার রাজনৈতিক শত্রুরা নিয়ন্ত্রণ করছে—যাদের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ধ্বংস করা। মৃত্যুদণ্ডের দাবি আসলে সেই একই হত্যাপ্রবণ লক্ষ্যকেই পরিবেশন করে।

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলেও শেখ হাসিনা এখন বলছেন, ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি জমা দিতে হয়। আমি কখনো এমন কোনো চিঠিতে সই করিনি, রাষ্ট্রপতিও কোনো পদত্যাগপত্র পাননি।’

কেবল ভারতের প্রশ্রয় ও সমর্থনে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করা শেখ হাসিনা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। আমি নিশ্চিত নই যে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন যদি হয়ও, আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে তা বৈধ হবে না।

আগের সাক্ষাৎকারগুলোয় প্রকাশিত নির্বাচন বর্জনের আহ্বানের সুর পাল্টে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্পষ্ট করে বলি: আমি বর্জনের আহ্বান জানাইনি। আমি শুধু বলেছিলাম, যদি আওয়ামী লীগকে ভোটে অংশ নিতে না দেওয়া হয়, তাহলে কোটি কোটি সমর্থক ভোট দেবে না, কারণ তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন করার সুযোগ পাচ্ছে না।’

বাংলাদেশে না ফেরার কারণ হিসেবে ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি’কে দায়ী করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ইউনূস তার মন্ত্রিসভায় কিছু ‘উগ্রপন্থিকে’ নিয়োগ দিয়েছেন, এই ঘটনাটা তাদের (উগ্রপন্থিদের) জন্য একধরনের উৎসাহের বার্তা দিচ্ছে এবং নিঃসন্দেহে তাদের বাস্তব সহায়তাও দিচ্ছে।