নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাতে দিল্লিকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা সরকার পছন্দ করছে না বলে জানানো হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে। উত্তরে বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে বাধা হওয়া উচিত নয়।
সংখ্যালঘু নিয়ে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু বিষয়ে আমরা বলেছি তাদের কোনো সংশয় থাকলে তারা আমাদের দেশে এসে সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কাম্য নয় এবং দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সঙ্গে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মো. জসীম উদ্দিন বলেন, আমরা সবসময় বলেছি যে, সীমান্তহত্যা যেন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়। তাদের দিক থেকে তারা বলেছে, সীমান্তে নানা ধরনের অপরাধ হয়। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এসব অপরাধের সংযোগ আছে।
পররাষ্ট্রসচিব এম জসীম উদ্দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এফওসির পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই প্রেক্ষিতে এফওসিতে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সামনের দিনে আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, এফওসিতে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামনে আলোচনা হয়। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নিকট আমরা আমাদের দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সকল অনিষ্পন্ন বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করি। আমি দুই দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দেই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।
বাংলাদেশ ও ভারতের ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফেরানোর প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাকে ফেরানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ আসার বিষয় আর এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত যখন হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন ব্যবস্থা নেবে। এটা এফওসিতে কেন, যে কোনো পর্যায়ে হতে পারে। সেটা কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমেও হতে পারে, জানানো যায় এবং দিল্লিতে আমাদের যে মিশন আছে তার মাধ্যমেও জানানো যায়।
ভারতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ পছন্দ নয় অন্তর্বর্তী সরকারের। সেই বার্তা দিল্লির পররাষ্ট্র সচিবকে ঢাকায় পেয়ে সরাসরি পৌঁছে দেন জসীম উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতে অবস্থান করে যে বক্তব্য রাখছেন এই বক্তব্যের প্রতি আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আপনারা গতকাল শুনেছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) একটি বক্তৃতা দিয়েছেন, এটা এই সরকার পছন্দ করছেন না এবং তারা যে কথাটা বলেছেন, তার উপস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি, তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতে বসে যে বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। তাদের (ভারতকে) আমরা বলেছি, আমরা যে এটা পছন্দ করছি না এটা তাকে (শেখ হাসিনাকে) যেন জানানো হয়। তারা (বিক্রম মিশ্রি) নোট নিয়েছেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তী সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছি। সেই সাথে আমরা জোর দিয়ে বলেছি যে, বাংলাদেশে বসবাসরত সব ধর্ম নির্বিশেষে স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছে এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা দেখার ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানিয়েছে। সেই সাথে আমরা এও বলেছি যে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়। আমি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত।
সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা অগ্রাধিকার উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব এম জসীম উদ্দিন বলেন, আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি জীবন মূল্যবান—একটি জীবনও অনেকেরও বেশি। এই লক্ষ্যে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অনুরোধ করেছি। তাছাড়া, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাই।
তিনি বলেন, আজকের আলোচনায় আন্তঃনদী বিষয়সমূহ গুরুত্ব পেয়েছে। আমি তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেই। গঙ্গা-পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। সে প্রেক্ষিতে তা নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেই। এ ছাড়াও, আরও যে কয়টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাধীন, সেসব সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ জোর দেই। বন্যা পূর্বাভাস, উপাত্ত/ডাটা আদান-প্রদানসহ বন্যা প্রতিরোধে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি এবং এ বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের মেকানিজম গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করি।
পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, ভারত আমাদের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফ এর মত বাধাসমূহ দূর করার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে ভারতের সাথে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত থেকে বর্তমানে প্রায় ২৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার জন্য আহবান জানিয়েছি।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, প্রতি বছর পর্যটন এবং চিকিৎসা উপলক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করে। তাদের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার সহজীকরণের জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। যেসকল বাংলাদেশি নাগরিক ভারতের আদালতের দেওয়া সাজা বাংলাদেশে অথবা ভারতে ভোগ করছে, তাদের সাজা মওকুফের বিষয়ে ভারতের যথাযথ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া, ভারতে আটক বাংলাদেশের জেলেদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আজকের আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে একযোগে কাজ করার বিষয়ে ভারত সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সোমবার ঢাকায় পৌঁছে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন। ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব। এর আগে সোমবার সকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজে ঢাকায় পৌঁছান বিক্রম মিশ্রি। তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ) ইশরাত জাহান।