Dhaka মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এশিয়ার দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

এশিয়ার দেশগুলোকে অভিন্ন সংকট মোকাবিলা এবং নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচনে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এশিয়া আজ বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি। তাই এই অঞ্চলকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘নিক্কেই ফোরাম : এশিয়ার ভবিষ্যৎ ৩০তম সম্মেলন’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য তিনি এ কথা বলেন। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য সাতটি দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, আমরা সবাই একটি অভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই ভবিষ্যৎ যেন সবার জন্য সমানভাবে সমৃদ্ধ হয়—তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এশিয়ার দেশগুলোকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সহযোগিতায় রূপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ আমরা “অশান্ত বিশ্বে এশীয় চ্যালেঞ্জ” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য এখানে সমবেত হয়েছি। তাই আমি বলব, বিশ্ব ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা এক বিরাট অনিশ্চয়তার সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি ভঙ্গুর, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সহযোগিতা সর্বদা নিশ্চিত করা হয় না।

তিনি বলেন, এশিয়া এবং তার বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত দেখা দিচ্ছে, শান্তি অধরা হয়ে উঠছে। যুদ্ধ এবং মানবসৃষ্ট সংঘাত ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নৃশংস রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ইতোমধ্যেই গভীর মানবিক সংকটকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, আমাদের দুই প্রতিবেশী একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

দুঃখ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছি যার ফলে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে বা মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংগ্রাম করছে। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য আমি দুই দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অব্যাহত শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশা করি।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে কিছু বিশেষ স্মৃতি ফিরে আসে। ২০ বছর আগে ২০০৪ সালে, নিক্কেই আমাকে এশিয়া পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন। এটি আমার জীবনের একটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। তারপর থেকে, আমি সর্বদা জাপানের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত সংযোগ অনুভব করেছি। বছরের পর বছর ধরে, আমি বহুবার জাপানে গিয়েছি। আমি জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করেছি, তরুণদের সঙ্গে দেখা করেছি এবং ধারণাগুলো ভাগ করে নিয়েছি। জাপানের জনগণ সামাজিক ব্যবসা এবং ক্ষুদ্রঋণের আমার ধারণাকে কতটা উষ্ণভাবে গ্রহণ করেছে তা দেখে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমি বিশ্বাস করি, মিলিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা এবং সমৃদ্ধির নতুন নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচনে এশিয়ার দেশগুলো আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং অভিন্ন সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সুস্পষ্ট পথ গড়ে তুলতে হবে। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা আমাদের চারপাশের অশান্তি দেখে হতাশ না হই। এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও লেখা হয়নি, আমরা একসঙ্গে লিখবো। বাংলাদেশ ও জাপান এশিয়ার ভাগ্য এমনকি বিশ্বের ভাগ্য পুনর্লিখনে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিশ্ব ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা চরম অনিশ্চয়তার সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে এবং সহযোগিতার নিশ্চয়তা সবসময় নেই। এশিয়া ও এর বাইরের অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, শান্তি অধরা হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ইতোমধ্যে গভীর মানবিক সংকটকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অতিসম্প্রতি, আমাদের দুই প্রতিবেশী একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, আমরা যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছি, আমাদের লাখ লাখ মানুষকে অনাহারে রাখছি। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অব্যাহত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশাবাদ ব্যক্ত করায় আমি দু’দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়, তবুও নতুন নৈতিক দ্বিধা উত্থাপন করে। বাণিজ্য বিধিনিষেধের উত্থান মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বিস্তৃত হচ্ছে, বৈশ্বিক আস্থা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জাতিগুলোর মধ্যে, সমাজের মধ্যে এবং এমনকি নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন বিভক্তি, অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা প্রত্যক্ষ করেছি যার ফলে সরকার পরিবর্তন হয়েছে।

বাংলাদেশে গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং ফলশ্রুতিতে আমার সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ, জনগণের ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্রে সুষ্ঠুভাবে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কঠোর পরিশ্রম করছি। আমরা বিশ্বাস করি, এটি ভুলগুলো সংশোধন করার, নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করার এবং একটি ন্যায্য সমাজের স্বপ্ন উপলব্ধি করার একটি সুযোগ। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার ভূমিকা পালন করছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তিবিনির্মাণ মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তায় অবদান রাখছে এবং সম্পূর্ণরূপে মানবিক কারণে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।

তিনি বলেন, অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এশিয়া এই অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। এটি একই সাথে সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি তা ভয়ঙ্কর, এবং আমাদের সম্মিলিত শক্তিও একই পরিস্থিতির মধ্যে আছে। এই বাস্তবতায়, আমি বিশ্বাস করি এশিয়ার একটি ভিন্ন পথ দেখানোর সুযোগ রয়েছে – সম্ভবত একটি দায়িত্বও রয়েছে। শান্তির, আলাপ-আলোচনার পথ, অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশের পথ। শুধু সংখ্যায় বৃদ্ধি নয়, মানুষের সুস্থতায়, আস্থায়, আশা বাড়াতে ।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা শক্তিহীন নই। আসলে আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমরা যে বিষয়গুলো গ্রহণ করব তা সিদ্ধান্ত নেবে যে আমরা আমাদের সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী ধরণের বিশ্ব রেখে যাবো। সেজন্য আমাদের একজোট হতে হবে – শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেই চলবে না, সমাধানও করতে হবে। যে সমাধানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং আমাদের মিলিত মানবতার মধ্যে প্রোথিত।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি প্রায়ই বলি, “অর্থ উপার্জন করা সুখ। কিন্তু মানুষকে খুশি করা দারুণ সুখের। আমাদের ফোকাস স্থানান্তর করতে হবে – ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সমষ্টিগত কল্যাণের দিকে। স্বল্পমেয়াদী লাভ থেকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক চালু করা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো যাত্রায় আমি একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে শিখেছি, মানুষ কষ্ট পাওয়ার জন্য জন্মায় না। মানুষ অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। আমাদের শুধু তাদের সঠিক সুযোগ দিতে হবে।

এসময় তিনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এর মধ্যে আছে – এশিয়ার পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে সহযোগিতায় রূপান্তর করা, শক্তিশালী প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, দারিদ্রতা দূর করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন স্থাপত্য তৈরি করা, বিনিয়োগের মাধ্যমে জীবনকে রূপান্তর করা , সবুজ রূপান্তর এবং যুব সমাজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি অশান্ত বিশ্বে জনগণের ক্ষমতায়ন এবং তৃণমূল নেতৃত্ব আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়াকে শুধু অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, বরং একটি নতুন নৈতিক কম্পাস দিতে হবে- যা ক্ষমতার চেয়ে শান্তি, প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতা, স্বল্পমেয়াদী লাভের চেয়ে টেকসইকে সমর্থন করবে। আমার দেশ বাংলাদেশে আমরা দেখেছি কীভাবে সামাজিক ব্যবসা লাখ লাখ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটা একটা শিক্ষা হোক, যখন মানুষকে মর্যাদা, বিশ্বাস এবং একটি সুযোগ দেওয়া হয়- তখন তারা উত্থিত হয়। শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, চেঞ্জ মেকার হিসেবেও।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

গুলিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনায় ট্রাকের হেলপার নিহত

অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এশিয়ার দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

প্রকাশের সময় : ১১:০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

এশিয়ার দেশগুলোকে অভিন্ন সংকট মোকাবিলা এবং নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচনে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এশিয়া আজ বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি। তাই এই অঞ্চলকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘নিক্কেই ফোরাম : এশিয়ার ভবিষ্যৎ ৩০তম সম্মেলন’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য তিনি এ কথা বলেন। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য সাতটি দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, আমরা সবাই একটি অভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই ভবিষ্যৎ যেন সবার জন্য সমানভাবে সমৃদ্ধ হয়—তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এশিয়ার দেশগুলোকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সহযোগিতায় রূপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ আমরা “অশান্ত বিশ্বে এশীয় চ্যালেঞ্জ” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য এখানে সমবেত হয়েছি। তাই আমি বলব, বিশ্ব ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা এক বিরাট অনিশ্চয়তার সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি ভঙ্গুর, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সহযোগিতা সর্বদা নিশ্চিত করা হয় না।

তিনি বলেন, এশিয়া এবং তার বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত দেখা দিচ্ছে, শান্তি অধরা হয়ে উঠছে। যুদ্ধ এবং মানবসৃষ্ট সংঘাত ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নৃশংস রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ইতোমধ্যেই গভীর মানবিক সংকটকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, আমাদের দুই প্রতিবেশী একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

দুঃখ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছি যার ফলে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে বা মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংগ্রাম করছে। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য আমি দুই দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অব্যাহত শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশা করি।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে কিছু বিশেষ স্মৃতি ফিরে আসে। ২০ বছর আগে ২০০৪ সালে, নিক্কেই আমাকে এশিয়া পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন। এটি আমার জীবনের একটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। তারপর থেকে, আমি সর্বদা জাপানের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত সংযোগ অনুভব করেছি। বছরের পর বছর ধরে, আমি বহুবার জাপানে গিয়েছি। আমি জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করেছি, তরুণদের সঙ্গে দেখা করেছি এবং ধারণাগুলো ভাগ করে নিয়েছি। জাপানের জনগণ সামাজিক ব্যবসা এবং ক্ষুদ্রঋণের আমার ধারণাকে কতটা উষ্ণভাবে গ্রহণ করেছে তা দেখে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমি বিশ্বাস করি, মিলিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা এবং সমৃদ্ধির নতুন নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচনে এশিয়ার দেশগুলো আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং অভিন্ন সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সুস্পষ্ট পথ গড়ে তুলতে হবে। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা আমাদের চারপাশের অশান্তি দেখে হতাশ না হই। এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও লেখা হয়নি, আমরা একসঙ্গে লিখবো। বাংলাদেশ ও জাপান এশিয়ার ভাগ্য এমনকি বিশ্বের ভাগ্য পুনর্লিখনে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিশ্ব ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা চরম অনিশ্চয়তার সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে এবং সহযোগিতার নিশ্চয়তা সবসময় নেই। এশিয়া ও এর বাইরের অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, শান্তি অধরা হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ইতোমধ্যে গভীর মানবিক সংকটকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অতিসম্প্রতি, আমাদের দুই প্রতিবেশী একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, আমরা যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছি, আমাদের লাখ লাখ মানুষকে অনাহারে রাখছি। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অব্যাহত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশাবাদ ব্যক্ত করায় আমি দু’দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়, তবুও নতুন নৈতিক দ্বিধা উত্থাপন করে। বাণিজ্য বিধিনিষেধের উত্থান মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বিস্তৃত হচ্ছে, বৈশ্বিক আস্থা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জাতিগুলোর মধ্যে, সমাজের মধ্যে এবং এমনকি নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন বিভক্তি, অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা প্রত্যক্ষ করেছি যার ফলে সরকার পরিবর্তন হয়েছে।

বাংলাদেশে গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং ফলশ্রুতিতে আমার সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ, জনগণের ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্রে সুষ্ঠুভাবে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কঠোর পরিশ্রম করছি। আমরা বিশ্বাস করি, এটি ভুলগুলো সংশোধন করার, নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করার এবং একটি ন্যায্য সমাজের স্বপ্ন উপলব্ধি করার একটি সুযোগ। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার ভূমিকা পালন করছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তিবিনির্মাণ মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তায় অবদান রাখছে এবং সম্পূর্ণরূপে মানবিক কারণে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।

তিনি বলেন, অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এশিয়া এই অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। এটি একই সাথে সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি তা ভয়ঙ্কর, এবং আমাদের সম্মিলিত শক্তিও একই পরিস্থিতির মধ্যে আছে। এই বাস্তবতায়, আমি বিশ্বাস করি এশিয়ার একটি ভিন্ন পথ দেখানোর সুযোগ রয়েছে – সম্ভবত একটি দায়িত্বও রয়েছে। শান্তির, আলাপ-আলোচনার পথ, অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশের পথ। শুধু সংখ্যায় বৃদ্ধি নয়, মানুষের সুস্থতায়, আস্থায়, আশা বাড়াতে ।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা শক্তিহীন নই। আসলে আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমরা যে বিষয়গুলো গ্রহণ করব তা সিদ্ধান্ত নেবে যে আমরা আমাদের সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী ধরণের বিশ্ব রেখে যাবো। সেজন্য আমাদের একজোট হতে হবে – শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেই চলবে না, সমাধানও করতে হবে। যে সমাধানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং আমাদের মিলিত মানবতার মধ্যে প্রোথিত।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি প্রায়ই বলি, “অর্থ উপার্জন করা সুখ। কিন্তু মানুষকে খুশি করা দারুণ সুখের। আমাদের ফোকাস স্থানান্তর করতে হবে – ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সমষ্টিগত কল্যাণের দিকে। স্বল্পমেয়াদী লাভ থেকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক চালু করা থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো যাত্রায় আমি একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে শিখেছি, মানুষ কষ্ট পাওয়ার জন্য জন্মায় না। মানুষ অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। আমাদের শুধু তাদের সঠিক সুযোগ দিতে হবে।

এসময় তিনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এর মধ্যে আছে – এশিয়ার পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে সহযোগিতায় রূপান্তর করা, শক্তিশালী প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, দারিদ্রতা দূর করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন স্থাপত্য তৈরি করা, বিনিয়োগের মাধ্যমে জীবনকে রূপান্তর করা , সবুজ রূপান্তর এবং যুব সমাজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি অশান্ত বিশ্বে জনগণের ক্ষমতায়ন এবং তৃণমূল নেতৃত্ব আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়াকে শুধু অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, বরং একটি নতুন নৈতিক কম্পাস দিতে হবে- যা ক্ষমতার চেয়ে শান্তি, প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতা, স্বল্পমেয়াদী লাভের চেয়ে টেকসইকে সমর্থন করবে। আমার দেশ বাংলাদেশে আমরা দেখেছি কীভাবে সামাজিক ব্যবসা লাখ লাখ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটা একটা শিক্ষা হোক, যখন মানুষকে মর্যাদা, বিশ্বাস এবং একটি সুযোগ দেওয়া হয়- তখন তারা উত্থিত হয়। শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, চেঞ্জ মেকার হিসেবেও।