নিজস্ব প্রতিবেদক :
অতীতে কখনও কেউ এভিয়েশন খাতে এত কাজ করেনি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ও ২০০১-০৭ এই ২৯ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা দেশকে কিছু দিতে পারেনি। একমাত্র আওয়ামী লীগই দেশের মানুষকে দিয়েছে।
শনিবার (৭ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ২৯ বছর যারা ক্ষতমায় ছিলেন তারা দেশের মানুষকে কিছুই দিয়ে যেতে পারেননি। আমরা এ দেশের মানুষকে সব দিয়েছি। আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দেখি বিমানবন্দরে বোর্ডিং ব্রিজ ছিল না, পার্কিং ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আমি যখন সরকারে আসি তখন আমাদের বিমানবন্দরের কোনো বোডিং ব্রিজ ছিল না, পার্কিং ব্যবস্থা ছিল না, কিছুই ছিল না। আমরা সরকারে এসে বিমানবন্দরের উন্নয়নের উদ্যোগ নিই। চট্টগ্রাম ও সিলেট, এ দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও আমরা নির্মাণ করি। সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল, এ সময়ে বিমানবন্দরের উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়। আমি সবাইকে অনুরোধ করব, যদি পারেন তাহলে ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত কী উন্নয়ন হয়েছিল, সেটি একটু দেখবেন।
তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য। আধুনিক যুগের নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-পথও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে, বিদেশের সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগ, সেই যোগাযোগের মূল বাহন হচ্ছে বিমান। অর্থাৎ আকাশযাত্রাটা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটিকে গুরুত্ব দিই।
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের বিমানবন্দর যাতে আরও আধুনিক এবং এতে আরও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা যায়, সেজন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। কারণ, আমাদের দেশ থেকে যেয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা বসবাস করেন। তারা বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। আমাদের রেমিট্যান্স পাঠান। তারাও যাতায়াত করে। তাদের সুবিধাটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কোনো দেশের থেকে পিছিয়ে নই। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? ভবিষ্যতে আমরাও চাঁদে যাব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এই দিকটা (অ্যারোস্পেস) যেন আরও উন্নত হয় সেজন্য অ্যারোস্পেস বিষয়ে আমাদের আরও গবেষণা করা দরকার। আমাদের লোকবল দরকার, এক্ষেত্রে আরও গবেষণাও দরকার। সেটিকে মাথায় রেখে আমাদের যারা অত্যন্ত মেধাবী তরুণ-তরুণী আছে, তাদের উপযুক্ত শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যে আমরা লালমনিরহাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এই দিকটা যেন আরও উন্নত হয়। আমরা দেখি আমাদের আশপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়, তো আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? আমরাও চাঁদে যাব। ভবিষ্যতে সেভাবেই আমরা দক্ষ জনশক্তি, স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব। আমরা চাই আমাদের দেশ এগিয়ে যাক আর এভিয়েশন খাতে বাংলাদেশ আরও উন্নত হোক।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, বর্তমানে শাহজালাল থেকে বাৎসরিক যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা ৮০ লাখ। তৃতীয় টার্মিনাল সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর তা এক কোটি ২০ লাখ থেকে দুই কোটি পর্যন্ত যাত্রীসেবা দেবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এই বাংলাদেশটাই এক সময় কক্সবাজার বা এই শাহজালাল হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের হাব। সেভাবে আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি।
তিনি বলেন, রিফুয়েলিংয়ের সবাই এখানে আসবে, থামবে, বাংলাদেশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করবে। আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সমুদ্রসৈকত সেটাও সবাই উপভোগ করতে পারবে। সেভাবে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই।
ঢাকাকেন্দ্রিক বিমান যোগাযোগের নির্ভরশীলতা কমাতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বিমান যোগাযোগ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে বিমান যোগাযোগের আন্তর্জাতিক হাব। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরকে সেভাবেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
এভিয়েশন খাতের নানা উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, একসময় কক্সবাজার ও হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে এশিয়ার আঞ্চলিক হাব। ভবিষ্যতে এখানে আরও একটা রানওয়ে করা হবে। কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সেখানে আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বিমানে আন্তঃজেলা সংযোগের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। এজন্য দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরগুলোকেও অত্যাধুনিক করা হচ্ছে। এগুলো অত্যাধুনিক হলে সৈয়দপুর, যশোর, রাজশাহী এসব বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট চলবে।
সরকারপ্রধান বলেন, দেশের এভিয়েশন খাতকে আরও উন্নত করার জন্য কিছু এয়ারবাস কেনা হবে। এজন্য কোম্পানিটি বাংলাদেশ সরকারকে লোন দেবে।
সরকারের নানা উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। বেকার মাত্র ২ দশমিক। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা হয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আমরা গ্রামের মানুষকে নিয়ে কাজ করছি। দেশের ১০ কোটি মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন প্রথম ক্ষমতায় আসি তখন বিমানবন্দরে কোনো বোডিং ব্রিজ ছিল না। আমরা তখন এই বিমানবন্দরের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিই। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করি।
সরাসরি পাইপ লাইনে জেট ফুয়েল আসবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এতে সময় ও অর্থও বাঁচবে। এই প্রকল্পের কাজ চলছে বলে জানান তিনি। একদিন দেশের মানুষ চাঁদেও যাবে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট সমাজ তৈরিরও কাজ করছি।
নানা বাধা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে থার্ড টার্মিনালের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। বিশেষ করে এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
বিভিন্ন সময়ে আকাশপথে যোগাযোগের রুট পরিবর্তন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন, একসময় আন্তর্জাতিক হাব ছিল হংকং। এরপর হলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড; এখন দুবাই। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের কক্সবাজার বা হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক হাব। রিফুয়েলিংয়ের জন্য অনেকেই এখানে আসবে, থামবে; বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সি বিচ সেটাও সবাই উপভোগ করতে পারবে। সেভাবেই আমরা গড়ে তুলতে চাই।
সরকারপ্রধান বলেন, আকাশপথের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন রাডার বসাচ্ছি। ভবিষ্যতে এখানে নতুন রানওয়ে করা হবে, সে পরিকল্পনাও আমাদের আছে। কক্সবাজারকে পর্যটন শিল্পকেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার অংশ হিসেবে কক্সবাজার বিমানন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ করে দিচ্ছি। এই রানওয়েটা একটু ভিন্নধর্মী হবে। প্লেনটা সাগরের ভেতরে নেমে আসবে বা উঠে যাবে – সেভাবেই করা হয়েছে। তাছাড়া সিলেট ওসমানি বিমানবন্দর সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নিয়েছি। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরও আরও উন্নত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রেলপথ, নৌপথ, সড়কপথ এবং আকাশপথ আধুনিক সম্পন্ন করে মানুষ যোগাযোগ সহজ করে ব্যবসা-বাণিজ্য-পর্যটন সবচেয়ে উন্নত করার ব্যবস্থা আমরা করব। আমাদের ঝরঝরে কয়েকখানা প্লেন ছিল। বর্তমানে আমাদের ২১টা এয়ারক্র্যাপ্ট রয়েছে বিমানবহরে; যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। তাছাড়া থার্ড টার্মিনাল আমাদের প্রায় আড়াই হাজার নতুন পথ সৃষ্টি হবে। অতীতে আমাদের এভিয়েশন খাতে উন্নয়নের এত পদক্ষেপ কেউ নেয়নি।
থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে সহযোগিতা করায় জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগের হাব। সবাই এখানে আসবে, বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। সেভাবেই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি।
শাহজালালে ভবিষ্যতে নতুন রানওয়ে হবে বলেও জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, কোভিডের অতিমারি সত্ত্বেও নির্মাণকাজ চলেছে। ৪ বছরের মধ্যে টার্মিনাল স্থাপন করেছি। জেড ফুয়েল যাতে সরাসরি শাহজালাল বিমানবন্দরে আসে, সে ব্যবস্থাও আমরা করে দিচ্ছি।
সড়ক, রেল ও আকাশ- সব পথে আধুনিক যোগাযোগ নিশ্চিত হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আকাশপথে আন্তঃজেলা যোগাযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এছাড়া সাগরের ভেতর দিয়ে উঠানামা করবে কক্সবাজার বিমানবন্দর। অন্যান্য বিমানবন্দরও উন্নতমানের হবে।
আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোড মডেল উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, গ্রামের মানুষকেও আমরা অবহেলা করিনি। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সে পরিকল্পনা করে দিচ্ছি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ার এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জাপানের সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় ভাইস মিনিস্টার মাসাহিরো কমুরা।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (বেবিচক) এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি শফিউল আজিম, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীসহ অনেকেই উপস্থিত রয়েছেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী সকাল সোয়া ১০টায় থার্ড টার্মিনালে আসেন। গেটে সরকারপ্রধানকে বরণ করেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর ও বিমান সচিব মোকাম্মেল হোসেন। তিনি গেট হয়ে প্রবেশের আগে ছোট ছোট মেয়েরা দেশের গানে নেচে অভিবাদন জানান। এরপর তিনি যান লাগেজ চেকিং পয়েন্টে। তাকে ১০টা ১৮ মিনিটে প্রতীকী বোডিং পাস দেওয়া হয়। পরে তিনি ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যান। ১০টা ২১ মিনিটে তিনি ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছেন।
প্রি বোডিং সিকিউরিটি জোন থেকে বোডিং ব্রিজ হয়ে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে সরকারপ্রধান নেমে যান দ্বিতীয় তলার অনুষ্ঠানস্থলে। তার আগে তিনি থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকালে তোলা ফটো গ্যালারি পরিদর্শন শেষে যান বোডিং ব্রিজের দিকে। সবশেষ তিনি মঞ্চের সামনে আসেন ১০টা ৩২ মিনিটে। এরপর আসন গ্রহণ করেন। পরে সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত পাঠ করেন এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়।