চট্টগ্রাম বন্দর পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে পণ্য গেল ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায়। এজন্য গত বৃহস্পতিবার কলকাতা বন্দর থেকে রওনা হয় একটি জাহাজ। মঙ্গলবার তা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ‘এমভি সেঁজুতি’ নামক ওই জাহাজে ভারতের ৪টি কনটেইনার ছিল। পরে ওই পণ্য খালাস করে রাতেই সড়কপথে আখাউড়ার উদ্দেশে রওনা দেয়।
২৫ টন করে পণ্য বহনকারী ২০ ফুটের (টিইইউ) প্রতিটি কনটেইনারের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা হারে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হয়েছে ভারতকে। যদিও ২০১০ সালে এ হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১০-এর নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ আদায় করা হয়েছে।
সূত্রমতে, মঙ্গলবার ভোররাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে ‘এমভি সেঁজুতি’। এরপর বন্দরের নিজস্ব পাইলটের নেতৃত্বে টাগ বোটের সহায়তায় জাহাজটি বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের এক নম্বর জেটিতে (বার্থ) আনা হয় বেলা ১টা ৪০ মিনিটে। জাহাজটিতে পণ্যবাহী ১৬০ একক কনটেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট) ছিল। এর মধ্যে চারটি কনটেইনার ভারতীয় পণ্যবাহী। বাকি ১৫৬টিতে ছিল বাংলাদেশের আমদানিকারকদের পণ্য। আর বাকি ১৪০টি কনটেইনার ছিল খালি।
ভারতের পণ্যবাহী চার কনটেইনারের মধ্যে দুই কনটেইনার রড ত্রিপুরার জিরানিয়ার এসএম করপোরেশনের। বাকি দুই কনটেইনার ডাল যাবে আসামের জেইন প্রতিষ্ঠানের কাছে। যদিও আমদানিকৃত পণ্য বাংলাদেশের ভেতর খালাস হবে নাÑএ যুক্তিতে গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবে কাস্টমস ফি আরোপ করা যায়নি এ পণ্যে।
চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের মাশুল আদায় করে। এর মধ্যে প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১০০ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন পণ্যে মাশুল দিয়েছে ২৭০ টাকা। এছাড়া প্রতি চালানের ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতিটি কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং বিধি অনুযায়ী ইলেকট্রিক সিল ও লক মাশুল প্রযোজ্য।
এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সিল ও লক লাগানোর চার্জ হিসেবে প্রথম ৪৮ ঘণ্টার জন্য ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৪৮ ঘণ্টা অতিক্রম করলে বাড়তি প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা হারে চার্জ আরোপ করা হবে। তবে বাংলাদেশের জন্য সড়ক ব্যবহারের জন্য এখনও কোনো চার্জ নির্ধারণ করা হয়নি।
এদিকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা
শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের অধীনে ২০১০ সালে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পণ্যের কাস্টমস ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১০’ শীর্ষক ওই বিধিমালায় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
বিধিমালায় বলা হয়, সড়ক বা রেলপথে প্রতি টিইইউ কনটেইনারের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি প্রযোজ্য হবে। সড়কপথে কাভার্ড ভ্যান বা কাভার্ড ট্রাকে পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে এক হাজার টাকা। আর নন-কনটেইনার জাহাজ বা রেলপথে পরিবহনের জন্য প্রতি টন বাল্ক পণ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে এক হাজার টাকা। এছাড়া ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট পণ্যের জন্য বিমা কাভারেজ বাধ্যতামূলক বলা হয়। আর কনটেইনার স্ক্যানিং চার্জ শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত হবে।
যদিও সে বছর ভারতের পিআইডব্লিউটিটির (প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড) অধীনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে দুটি জাহাজে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রদানে আপত্তি জানায় ভারত। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি আদায় স্থগিত করা হয়। আর পরের বছর বিধিমালাটি বাতিল করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে পিআইডব্লিউটিটির আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার শুরু করে ভারত। এতে বন্দর থেকে আখাউড়া দিয়ে ভারতে যায় পণ্যবাহী ট্রাক। সে বছর প্রতি টনে মাত্র ১৩০ টাকা মাশুল নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতি টনে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ১০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা ও সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কনটেইনারে (২৫ টন) ট্রান্সশিপমেন্ট ফি পড়বে ৫০০ টাকা। আর চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নির্ধারিত মাশুলেও প্রতি কনটেইনারের ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৫০০ টাকা।
এদিকে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা কনটেইনার সড়কপথে আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে প্রবেশ করে। তবে বাংলাদেশের জন্য সড়ক ব্যবহারের জন্য এখনও কোনো চার্জ নির্ধারণ করা হয়নি। পরীক্ষামূলক চালানে বিনা চার্জেই যাচ্ছে পণ্য।
যদিও গত ডিসেম্বরে টনপ্রতি পণ্যের জন্য প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ১০ পয়সা হারে ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়। তবে ভারতের সঙ্গে সচিব পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ প্রস্তাবে সম্মত হয়নি দেশটি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, বন্দর ব্যবহার ফি দেওয়া হলে আবার সড়ক ব্যবহার ফি কেন দিতে হবে!
এদিকে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের চার্জ আরোপ করা হবে, তা নির্ধারণে ২০১১ সালে গঠন করা হয়েছিল কোর কমিটি। ২০১২ সালে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওই কমিটি। তাতে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি চার দশমিক ২৫২৮ টাকা চার্জ আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর বাইরে কাস্টমস সার্ভিস চার্জ যানবাহনপ্রতি ৫ হাজার ২২০ টাকা আদায়ের প্রস্তাব করে কোর কমিটি।
যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে আদায় করা হয়েছে মাত্র প্রতি টনে ২৭০ টাকা। আর চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বাংলাদেশ ও ভারতের আমদানিকারকদের জন্য একই। অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত হারেই বন্দর ব্যবহার চার্জ গুনতে হবে ভারতকে।