সিলেট জেলা প্রতিনিধি :
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্য ২ হাজার মানুষ জীবন দেয়নি, অর্ধলক্ষ মানুষ রক্ত দেয়নি। রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য ছাত্র-জনতার এই রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান। সুতরাং প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। যে সিস্টেমগুলো সংস্কারের প্রয়োজন তা সংস্কার শেষেই যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন দেওয়া উচিত।
শনিবার (৯ নভেম্বর) সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে আর্থিক অনুদানের চেক বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, কোনো বড় দলই বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্টের একটি চুলও নড়াতে পারেনি। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও রক্তের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সারজিস বলেন, আমরা বলছি না সংস্কার করতে পাঁচ বছর লাগবে। কমপক্ষে একটা যৌক্তিক সময় এই সরকারকে দিতে হবে। নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচন কমিশন দরকার সেই কমিশনকে সংস্কার করতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি ভোটার তালিকা দিলো আর তফসিল দিলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি নির্বাচন এলে অনেকেই নানা ইশতেহার দেয়। কিন্তু কোনোভাবে ক্ষমতায় গেলেই তারা সেটা ভুলে যায়। তাই আমাদের উদ্দেশ্য হলো ফ্যাসিবাদী শাসনে ধ্বংসপ্রায় রাষ্ট্রযন্ত্রেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিস্টেমের সংস্কার। এজন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন নেই। তবে ন্যূনতম একটা সময় এই সরকারকে দিতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমগুলোর জন্য বিগত ১৬ বছরে মানুষ বিরক্ত হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ১৬ বছরে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচন কমিশন সংস্কার না করলে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যাবে না। শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্য ২ হাজার মানুষ জীবন দেয়নি আর এ অভ্যুত্থানও হয়নি।
সারজিস আলম বলেন, আমরা বলছি না রাষ্ট্রের সবকিছু সংস্কার করে নির্বাচনে যান। আমরা এটাও বলছি না আগামী ৫-৬ বছর সংস্কার করেন। কিন্তু সংস্কারের জন্য ন্যূনতম একটা যৌক্তিক সময় লাগবে। কোনো বিবেকবান মানুষ তার জায়গা থেকে চিন্তা করতে পারবে না যে এক বছরের মধ্যে সবকিছু সংস্কার হয়ে যাবে। ১৬ বছর ধরে যে সিস্টেমগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হয়েছে, সেই সিস্টেমগুলোকে সংস্কার করতে একটা যৌক্তিক সময় প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, বিগত ১৬ বছর এমনকি ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সংবিধান পাঁচ বছরের জন্য দেশের মানুষকে একটি ‘জনতার সরকার’ উপহার দিতে পারেনি। আমাদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। সেই সাংবিধানিক সংস্কারও প্রয়োজন।
সারজিস আলম বলেন, প্রত্যেক পাঁচ বছরের জন্য বড় বড় ইশতেহার দিয়ে প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরপরই তারা ইশতেহার ভুলে যায়। তারা ভুলে যায় তারা যে জনতার সরকার।
তিনি আরও বলেন, শুধু একটা নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারে না। এর পাশাপাশি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। তা না হলে নির্বাচন দিলে আবার জবরদখলের ঘটনা ঘটতে পারে। ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। আবার এ নির্বাচন ঘিরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেজন্য একটা বিচারিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তাই বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
সারজিস আলম বলেন, হাইকোর্টে এখনও আওয়ামী লীগের কিছু দোসর-ফ্যাসিস্ট বসে আছে। যারা তাদের যোগ্যতার বলে সেখানে যায়নি। তোষামোদি আর তেলবাজি করে তারা সেখানে গিয়েছিল। তাদের এ জায়গা থেকে অপসারণ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে যারা এ জায়গাগুলোর জন্য যোগ্য তাদের সেখানে বসাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এ অভ্যুত্থান কিছু লোক দিয়ে হয়নি। যেই ফ্যাসিস্ট সরকারকে ১৬ বছরে বাংলাদেশের নামিদামি রাজনৈতিক সংগঠন এক টনক নড়াতে পারেনি, সেই শেখ হাসিনা কিছু লোকের জন্য এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। পুরো বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছিল বলে অভ্যুত্থান ঘটেছিল এবং শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়েছিল।
শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেক বিতরণ প্রসঙ্গে সারজিস আলম বলেন, সারা দেশ থেকে প্রায় ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি শহীদ পরিবারের তালিকা আমাদের কাছে এসেছে। আপাতত যাচাই-বাছাই করে নির্বাচিতদের পরিবারের হাতে আর্থিক অনুদানের চেক দেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে শহীদের পরিবারের হাতে অনুদানের চেক তুলে দিচ্ছি। এটা আমাদের দায়িত্ব। বাকি যারা রয়েছেন তাদের কাগজপত্র সংগ্রহের কাজ চলছে। সেগুলো হাতে পেলে অনুদানের চেক তুলে দেওয়া হবে।
চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৩২ জন শহীদের তালিকা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ১৮ জনের হাতে ৫ লাখ টাকা অনুদানের চেক তুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি ১২ জনের কাগজপত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকায় তাদেরকে আপাতত চেক দেওয়া হয়নি। যাচাই-বাছাই শেষে পরবর্তীতে তাদের হাতে অনুদানের চেক দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।