আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মধ্য দিয়ে ২৪৮ বছরের মার্কিন ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয় বারের মতো হোয়াইট হাউসের মসনদে বসলেন তিনি।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা) ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল রোটুন্ডায় অনুষ্ঠিত হয় তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।
দুটো বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেন তিনি। একটি বাইবেল তার মায়ের দেওয়া। অন্যটি আব্রাহাম লিংকনের বাইবেল। এই বাইবেলে শপথ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে আগের কয়েকজন প্রেসিডেন্ট; যার মধ্যে আছেন আব্রাহাম লিংকন নিজেও। ১৮৬১ সালে তিনি এ বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নেন।
তাকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। তার আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স।
শপথ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, আমি শপথ করছি যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করবো এবং আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং রক্ষা করবো।
শপথ নেওয়ার পর ট্রাম্পকে তার পরিবারের সঙ্গে মুহূর্তটি উদযাপন করতে দেখা যায়। ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প, ছোট ছেলে ব্যারন ট্রাম্প, টিফানি ট্রাম্প, লারা ট্রাম্প, এরিক ট্রাম্প, জ্যারেড কুশনার, ইভাঙ্কা ট্রাম্প এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ বাক্য দেশটির সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম ধারায় নির্ধারিত। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য ফেডারেল কর্মকর্তার শপথ সংবিধানে উল্লেখ নেই। এগুলো কংগ্রেসের প্রণীত আইনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ ও তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং তার প্রেমিকা লরেন সানচেজ। ক্যাপিটল ভবনে অতিথিদের আসনে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ট মিত্র ইলন মাস্কও।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন উপস্থিত ছিলেন। যদিও ২০২০ সালে বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না ট্রাম্প।
অতিথিদের মধ্যে আরও ছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
শপথ নিয়ে ট্রাম্প প্রথম ভাষে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে স্বর্ণালী যুগের সূচনা হলো এখন। এইদিন থেকে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ হবে এবং সম্মানিত হবে। আমি খুব সহজ কাজ করবো- আমেরিকা ফাস্ট হবে পলিসি। এর আগে তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট সহ উপস্থিতদের প্রতি সম্মান জানান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, আমাদের সার্বভৌমত্বকে পুনরুদ্ধার করা হবে। আমাদের নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করা হবে। ন্যায়বিচারের দাড়িপাল্লা পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ে জঘন্য হিংসাত্বক ও অন্যায়ভাবে হাতিয়ার করা ইতি ঘটবে। আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হবে এমন একটি জাতি সৃষ্টি করা যারা গর্বিত হবে, সমৃদ্ধ হবে এবং স্বাধীন থাকবে।
ট্রাম্প তার বক্তব্যে বলেন, আমেরিকা শিগগিরই আগের চেয়ে বৃহত্তর, শক্তিশালী এবং অধিক বেশি ব্যতিক্রমী হবে, যা আগে হয়নি কখনো। তিনি আরও বলেন, আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদ নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্সিতে ফিরেছেন। জাতীয় সফলতার একটি রোমাঞ্চকর নতুন যুগের সূচনা। সূর্যালোক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সুযোগকে আমেরিকার এমনভাবে ব্যবহারের সুযোগ এসেছে, যা আগে কখনো হয়নি।
সূচনা বক্তব্যেই বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এবং অভিবাসী সংকট মোকাবিলাকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, দেশের চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুতই উবে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র উগ্রপন্থি এবং দুর্নীতিপরায়ণ এস্টাবলিশমেন্টের ওপর আস্থার সংকটে লড়াই করছে।
ট্রাম্প বলেন, বিদায়ী প্রশাসন বিপজ্জনক অপরাধীদেরকে দেশে অভয়ারণ্য এবং সুরক্ষা দিয়েছে। এসব অপরাধী অবৈধ উপায়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে।
বিদায়ী সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সরকার বিদেশী সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য আনলিমিটেড তহবিল দিয়েছে। কিন্তু তারা আমেরিকার সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন আমাদের এমন একটা সরকার আছে যে দেশে আর একটি সঙ্কটও হতে দেবে না। নর্থ ক্যারোলাইনার ঘূর্ণিঝড় ও লস অ্যানজেলেসের দাবানল নিয়েও কথা বলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
তিনি বলেন, দাবানল কিছু ধনী এবং সবচেয়ে শক্তিধর মানুষকে ক্ষতিগ্রসত করেছে। তাদের অনেকেই এই হলে উপস্থিত আছেন। তাদের এখন কোনো বাড়িঘরই নেই। বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে,যা বিপর্যয়ের সময়ে কোনো সেবা দেয় না। বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে এ খাতে অধিক অর্থ খরচ করা হয়েছে। দেশে একটি শিক্ষা ব্যবস্থা আছে, যা আমাদের সন্তানদেরকে নিজেদের কাছেই লজ্জিত হতে শিক্ষা দেয়। এসবই পাল্টে যাবে। শুরু হলো আজ থেকে। দ্রুতই পাল্টে যাবে।
তিনি বলেন, তার সরকার মর্যাদা, ক্ষমতা ও শক্তি দিয়ে প্রতিটি সঙ্কট মোকাবিলায় কাজ করবে। প্রতিটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ধর্মের নাগরিকদের জন্য সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনবে। তিনি ২০শে জানুয়ারি ২০২৫’কে লিবারেশন ডে বা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উল্লেখ করেন।
ট্রাম্প বলেন, আমার আশা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন সবচেয়ে মহৎ হিসেবে আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্প্যানিক ভোটারদের তিনি বলেন, আপনাদের কণ্ঠস্বর আমি শুনেছি। প্রতিশ্রুতি দেন প্রথম দিনেই দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত বিষয়ক জাতীয় জরুরি অবস্থায় স্বাক্ষর করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বিদেশি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দেন মুদ্রাস্ফীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনের জীবন ধারণের খরচ মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প। আবারও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গ্রেট নেশন’ বানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। বিদেশি সোর্স থেকে রাজস্ব আয়ের ওপর জোর দেন।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে বাইডেনের অভ্যর্থনা
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানান জো বাইডেন। বাংলাদেশ সময় সোমবার (২০ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জো বাইডেনের সঙ্গে ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনও ছিলেন। আর ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও নতুন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া।
এ সময় সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সঙ্গে জনতার উদ্দেশেও কিছু বলেননি তিনি।
ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রবেশের সময় জো বাইডেনের কাছে তার অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়। তিনি এক শব্দে বলেন, ‘‘ভালো।’’
হোয়াইট হাউসে বিদায়ী ও নবাগত প্রেসিডেন্টের রূদ্ধদ্বার ‘টি মিটিং’ অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৩৭ সাল থেকে দেশটিতে এই চর্চা রয়েছে।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশের কিছুক্ষণ আগে উল্টো দিকে অবস্থিত সেন্ট জন্স চার্চে যান ট্রাম্প। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পসহ পরিবারের সদস্যরা।
সেখান থেকে মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে হোয়াইট হাউসে যান ট্রাম্প।
ট্রাম্পকে ঢাকঢোল পিটিয়ে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানালেও জো বাইডেনকে ট্রাম্প সেই সুযোগ দেননি। বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়েও পরাজয় স্বীকার করতে চাইছিলেন না ট্রাম্প। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একরকম পেছন দিয়ে হোয়াইট হাউস ছেড়েছিলেন ট্রাম্প। ফলে হোয়াইট হাউসকে বাইডেনকে তার স্বাগত জানানো হয়নি। অবশ্য বাইডেন তার উত্তরসূরি হিসেবে ট্রাম্পকে সেই সম্মান দিয়েছেন।