সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কে শুধু গতিরোধকের কারণে দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান পুলিশ বা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে নেই। যদিও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এসব গতিরোধককেই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
২৫ ডিসেম্বর বাগেরহাটের মোংলায় সড়কের গতিরোধকে ধাক্কা খেয়ে গুরুতর আহত হন মোস্তাফিজুর রহমান সোহান নামের আরেক ব্যক্তি। তিনদিন পর ২৮ ডিসেম্বর তিনিও মারা যান।
সিরাজগঞ্জ সার্কিট হাউজের সামনে একটা গতিরোধক আছে। গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন পৌর এলাকার নাঈম হোসেন। অন্ধকারে গতিরোধকের অবস্থান বুঝতে পারেননি তিনি। গতিরোধকে ধাক্কা লেগে সজোরে মোটরসাইকেল নিয়ে আছড়ে পড়েন। সে রাতেই হাসপাতালে মৃত্যু হয় নাঈমের।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এসব আলোচনায় অপরিকল্পিত গতিরোধকগুলোকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। এসব গতিরোধক তুলে দেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে একটি হালনাগাদকৃত পরিসংখ্যান চেয়েছিল কমিটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, সারা দেশের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১০টি জোনের আওতাধীন সড়ক-মহাসড়কগুলোয় এখনো ১ হাজার ১৮৮টি গতিরোধক রয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এসব সড়ক-মহাসড়ক থেকে ৭৫৫টি গতিরোধক অপসারণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সওজের জোনগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক গতিরোধক রয়েছে চট্টগ্রাম জোনে। এ জোনের সড়ক-মহাসড়কে এখনো ২৪৮টি গতিরোধক রয়েছে।
অপরিকল্পিত গতিরোধকের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় দেশের প্রায় সব সড়ক-মহাসড়কেই। এসবের অনেকগুলোতেই সাদা রংয়ের রোড মার্কিং করা নেই। অনেক গতিরোধকের সামনে আবার সাইনবোর্ডও নেই। ফলে এসব গতিরোধক অনেক সময়েই চালকের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। কমানোর বদলে হয়ে উঠছে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ।
অব্যাহত দুর্ঘটনার জেরে ২০১১ সালেই মহাসড়ক থেকে গতিরোধক অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। সে সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে, সওজের অধীনে সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের পরিমাণ কম-বেশি ২২ হাজার কিলোমিটার। এসব সড়কে বিদ্যমান গতিরোধকের পরিমাণ ১ হাজার ১৮৮টি।
আরও পড়ুন : তৃতীয় দফায় যানবাহনের কাগজপত্র হালনাগাদের সুযোগ
জোনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের ঢাকা জোনে গতিরোধক রয়েছে ১৮৮টি। একইভাবে ময়মনসিংহ জোনে ৮৫টি, কুমিল্লা জোনে ১২৬, সিলেট জোনে ৬০, চট্টগ্রাম জোনে ২৪৮, বরিশাল জোনে ৬২, খুলনা জোনে ১১১, রাজশাহী জোনে ৫৯, গোপালগঞ্জ জোনে ৯৯ ও রংপুর জোনে ১৫০টি গতিরোধক রয়েছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে অপসারিত গতিরোধকের সংখ্যা ৭৫৫। সবচেয়ে বেশি গতিরোধক অপসারণ করা হয়েছে রংপুর জোন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে সেখান থেকে ১৪৬টি গতিরোধক অপসারণ করেছে সওজ। একইভাবে ময়মনসিংহ জোনে ১৪২টি ও চট্টগ্রাম জোনে ১২৫টি গতিরোধক অপসারণ করা হয়েছে।
এছাড়া অধিদপ্তরের ঢাকা জোন থেকে ১৮টি, কুমিল্লা থেকে ৯৫, সিলেট থেকে ৩২, বরিশাল থেকে ৩০, রাজশাহী থেকে ৬৪ ও গোপালগঞ্জ জোন থেকে ৪৭টি গতিরোধক অপসারণ করা হয়েছে।
সড়ক-মহাসড়কে গতিরোধক দেয়ার কারণ জানতে চাইলে সওজের একজন প্রকৌশলী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, সাধারণত হাট-বাজার এলাকা এবং স্কুল-কলেজ-হাসপাতালের সামনে গতিরোধক দেয়া হয়। দুর্ঘটনা বাড়ানো নয়, গতিরোধক দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্ঘটনা কমানো।
এক্ষেত্রে কমানোর বদলে গতিরোধকগুলো কেন দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে অপরিকল্পিত গতিরোধকগুলোয়। সচরাচর কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে গতিরোধক দেয়ার দাবি তোলেন স্থানীয়রা। দুর্ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল থেকেও গতিরোধক স্থাপনের জন্য চাপ দেয়া হয়। মূলত এসব অপরিকল্পিত গতিরোধকই মহাসড়কে দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে মহাসড়কে গতিরোধক দেয়ারই পক্ষপাতী নন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেইন। তিনি বলেন, মহাসড়কে সাধারণত গতিরোধক দিতে নেই। দিলেই সেগুলো যথাযথভাবে পরিকল্পনা করে দিতে হয়, যাতে তা সহজেই চালকের নজরে পড়ে ও তিনি গতি কমাতে বাধ্য হন।
শুধু গতিরোধক বানালেই হবে না, সেগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও করতে হয়। কিন্তু মহাসড়কে যদি আননোটেবল অবস্থায়, যথাযথ পরিকল্পনা না করে গতিরোধক বসানো হয়, তাহলে অবশ্যই তা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠবে।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার ৪২০। এসব গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্স রয়েছে এমন চালকের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৪। সে হিসেবে ৭ লাখ ৩১ হাজার ২৪৬টি গাড়ির বৈধ কোনো চালকই নেই। দক্ষ বা বৈধ চালক সংকটে বিভিন্ন সময় সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে।
এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে গতিরোধক বসানোর চেয়ে চালকের দক্ষতা বাড়ানো বেশি জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণও প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
জাতীয় সংসদের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন বলেন, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ চালকদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। সেজন্য চালকদের দক্ষতা কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, সে বিষয়টি ভাবতে হবে। এছাড়া তাদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পরিপালন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এর আগেও একাধিক বৈঠকে সুপারিশ করেছি, যাতে গতিরোধকগুলো তুলে ফেলা হয়। অপ্রয়োজনীয় গতিরোধকের কারণে অনেক সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। সেজন্যই আমরা সংসদীয় কমিটির বৈঠক থেকে সুপারিশ করেছিলাম যাতে গতিরোধকগুলো তুলে দেয়া হয়।
কিন্তু এর পরও দেখা যাচ্ছে এখনো সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে গতিরোধক রয়ে গিয়েছে। এসব গতিরোধক সরিয়ে ফেলতে আবারো পরামর্শ দেয়া হয়েছে।