পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রাস্তার ওপর দিয়ে টানা হচ্ছে রেললাইন। কিন্তু লাইনের উচ্চতা এত কম যে নিচের হেডরুম দিয়ে বেশি উচ্চতার যানবাহন সেতুতে ওঠানামা করতে পারবে না। পদ্মাসেতুতে ওঠার এক প্রান্ত মাওয়া এবং অন্য প্রান্ত জাজিরায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ায় রেললাইনের কাজে আপত্তি জানিয়েছে সেতু বিভাগ।
এমতবস্থায় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প পরিদর্শন করেন। এসময় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে ত্রুটি ধরা পড়েছে এটি এখনই বলার সময় আসেনি। আমরা দেখার জন্য এসেছি। রেল সংযোগ প্রকল্পে খুব যে বড় ধরনের সমস্যা তা নয়। আসলে সমস্যা আছে কিনা তাও বলা যাবে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মতামত না দিবেন।
তিনি বলেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার দিন রেলও চালু হবে। তবে সেটা ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত। খুলনা পর্যন্ত রেল চালু করতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় আছে। ওই সময়ের মধ্যে পুরোপুরি রেল চালু হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জেন মাওয়া প্রান্তে রেলসংযোগ প্রকল্প পরিদর্শনকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, রেল প্রকল্পে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে সেটা তেমন কোনো সমস্যা নয়। প্রকল্পটির কাজ চলমান। এমতবস্থায় সমস্যা দেখা দিলে সেটার সমাধান আছে। আমি মনে করি, এটা কোনো বড় সমস্যা নয়। এটা বিশেষজ্ঞরা সমাধান করবেন।
রেলমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পে রেলের যেভাবে কাজ চলছে সেটির ব্যাপারে সড়ক নতুন ধরনের কনডিশন (শর্ত) দিয়েছে, কিন্তু সড়ক বিভাগ এখনো ডিজাইন দেইনি। যেহেতু এটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংশয় সেহেতু আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম আছে তারা এটি নিয়ে বসবেন। যদি নকশা কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং মতানৈক্য হয় তবে আমরা আশা করছি তারাই এটি সংশোধন করতে পারবেন।
সেতু বিভাগ ও রেল বিভাগের কাছে ডিজাইন চাওয়া হয়েছে। তারা ডিজাইন দিলেই সংশোধন করা হবে। অন্য কোথাও সমস্যা নেই। শুধু রেলের অংশ নামার ও উঠার সময় সমস্যা কথা উঠছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় করা হবে।
এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এটি একটি জাতীয় প্রকল্প। ত্রুটি শব্দটির সাথে আমরা একমত নই। ত্রুটি তখনই হবে যখন এটি চূড়ান্তভাবে হবে। প্রকল্পটি এখনো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, কিন্তু সংশয় যেটি দেখা দিয়েছে এরকম হয়তো আরো দেখা দিতে পারে। পৃথিবীর যেকোনো প্রকল্পেই এমন হতে পারে। তবে এখনো নকশা চূড়ান্ত হয়নি, আমাদের হাতে সময় আছে। যেহেতু এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তাই উচ্চতর পর্যায়ে আলোচনা করে অবশ্যই সমাধান করা হবে। প্রয়োজনে সকল ইঞ্জিনিয়ার একত্রিত করা হবে এবং স্যাটেল করা হবে।
মাওয়া প্রান্ত পরিদর্শনের পর রেলমন্ত্রী জাজিরা প্রান্ত পরিদর্শন করেন। সেখানে মন্ত্রীকে জানানো হয়, এটা খুব বড় সমস্যা নয়। বিশেষজ্ঞরা এক সাথে বসলেই এটার সমাধান হয়ে যাবে। রেলমন্ত্রী এরপর পদ্মা সেতুতে উঠে রেলের কাজের অগ্রগতি দেখেন। এসময় তিনি বলেন, জাজিরা প্রান্তে রেলের প্রায় ৫৬ ভাগ কাজ শেষ। মাওয়া প্রান্তে কাজের অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ। করোনার মধ্যেও দ্রুত কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করছি পদ্মা সেতু যে দিন চালু হবে সেদিন অর্থাৎ আগামী বছরের ডিসেম্বরে রেলও চালু হবে।
তিনি জানান, আগামী বছর ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল চালু করা সম্ভব হবে। সেতুর উপরের অংশ পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ দেখেন। ভাঙ্গার যেখানে জংশন স্টেশন হবে সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা নিজের চোখে দেখলেন কাজের অগ্রগতি। রাতদিন অবিরাম কাজ চলছে। এতে করে পদ্মা সেতুর সাথে রেল চালু হবে বলেই আমার বিশ^াস।
উল্লেখ্য, সম্পতি পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে রেল ও সড়ক পথে মাঝের উচ্চতা কম হয়েছে মর্মে সেতু বিভাগ রেল সংযোগ সড়ক নিয়ে আপত্তি জানায়। এতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সংযোগ সড়কের কাজ বন্ধ রেখে নতুন করে নকশা প্রণয়ন করে সমস্যার সমাধান করতে বলা হয়।
মূল পদ্মাসেতুর ভেতরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ কাজ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে সেতুর দুই পাড়ের রেল লাইন নিয়ে, যা ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত এবং পদ্মাসেতুর ওপাড়ে জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প নামে পরিচিত, যার কাজ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ।
দেশে মহাসড়কগুলোতে নিয়ম অনুযায়ী হেডরুম উচ্চতা রাখতে হয় সবনিম্ন ৫ দশমিক ৭ মিটার। কিন্তু পদ্মা রেললিংক প্রকল্পে মাত্র ৪ দশমিক ৮ মিটার উচ্চতা দেওয়ায় এ সমস্যা হয়েছে। অর্থাৎ পদ্মাসেতুর উভয় প্রান্তের হেডরুম উচ্চতা প্রায় এক মিটার কম। এই উচ্চতায় রেললাইন গেলে নিচে সড়কপথে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান আটকে যাবে।
এমনকি এর জন্য দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে আসা কোনো কনটেইনার ট্রাক এই উচ্চতায় পদ্মাসেতুতে উঠতে পারবে না। যদিও গতকাল এ বিষয়ে মাওয়া প্রান্তে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, হেড রুমের উচ্চতা নিয়ে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। আমরা মনে করি এটা কোনো বড় সমস্যা নয়। নকশার পরিবর্তন না করেও এটার সমাধান করা সম্ভব।