দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কগুলোতেই দুর্ঘটনাপ্রবণ এমন বাঁক সবচেয়ে বেশি। সড়কে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধও বেশি হয় এ মহাসড়কগুলোতে। গত ১০ বছরের দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে ৮৮৩টি অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁক চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
বরিশাল থেকে গৌরনদী মহাসড়ক। মাত্র ৩৫ কিলোমিটার এ পথে রয়েছে চারটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। সড়কের দুই পাশে গাছের সারি। সবুজের ফাঁকে থাকা এসব বাঁকে তাই বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহনের অবস্থান সহজে বুঝতে পারেন না চালকরা। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়।
দুর্ঘটনা রোধে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রমও হাতে নিয়েছে তারা। বিশেষজ্ঞরা যদিও বলছেন, কেবল সচেতনতাই নয়, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মহাসড়ককে করতে হবে বাঁকমুক্ত।
হাইওয়ে পুলিশের বিশ্লেষণ মতে, সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ৩০ শতাংশ বিপজ্জনক বাঁকই দক্ষিণ বিভাগের মাদারীপুর রিজিয়নের মহাসড়কে। অর্থাৎ এ রিজিয়নের আওতায় থাকা মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, বরিশাল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর ও নড়াইলে মোট ২৬৪টি দুর্ঘটনাপ্রবণ বাঁক রয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪৮টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে বগুড়া রিজিয়নের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনার মহাসড়কে। এছাড়া কুমিল্লা অঞ্চলে ১৮১টি, সিলেটে ১২৬টি ও গাজীপুর অঞ্চলের মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে মোট ৬৪টি।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, মাদারীপুর অঞ্চলের বরিশাল-ভুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে অন্তত দুই ডজন। এর মধ্যে কাশিপুরের বন বিভাগ ও সমবায় ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তা, গড়িয়ারপাড়ের জননী পেট্রলপাম্প ও কলাডেমা, ক্যাডেট কলেজ, রহমতাপুর সেতুর ঢাল, বিমানবন্দর মোড়, দোয়ারিকা ব্রিজের ঢাল, জয়েশ্রী, গৌরনদী প্রবেশপথ, বামরাইল স্কুলসংলগ্ন, বাটাজোর, আশুকাঠি, টরকি বাজার, কটকস্থল, বার্থি, ভুরঘাটা সেতুর আগের বাঁকটি সবচেয়ে বিপজ্জনক। মহাসড়কের এসব স্থানে আরো ঝুঁকি বাড়িয়েছে অবৈধ যানবাহন। থ্রি হুইলার, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, ভটভটি, নছিমন ও করিমনের মতো নিষিদ্ধ যানবাহনের কারণেই মহাসড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানায় হাইওয়ে পুলিশ। গত এক বছরে সড়ক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এ অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এর পরই রয়েছে যথাক্রমে কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও বগুড়া অঞ্চল।
ঢাকা-বরিশাল রুটে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাস চালান জমির উদ্দিন মোল্লা। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ বাসচালক বলেন, ‘মহাসড়কটিতে ২০-২৫টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরের বাঁক, জয়েশ্রী, আশুকাঠি, টরকি বাজার, বার্থি, তারা শংকর মন্দির, ভুরঘাটা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁকের আগে দিকনির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড থাকলেও অনেক সময় গতির কারণে খেয়াল করা যায় না। সড়কের দুই ধারে প্রচুর গাছ থাকায় দুটি পরিবহন মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত কেউ কাউকে দেখতে পারে না। তাই নতুন চালকেরা অনেক সময় এসব বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন।’ অভিজ্ঞ এ চালক আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিপজ্জনক বাঁকগুলোয়ও তাই আগের চেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় পড়ছে যানবাহন।’
রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা ট্রাক স্ট্যান্ডে সম্প্রতি কথা হয় পিকআপ ভ্যানচালক সুজন শেখের সঙ্গে। সারা দেশেই তিনি পণ্য পরিবহন করেন। এর মধ্যে সপ্তাহে দুই দিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক ধরে পণ্য নিয়ে যান জানিয়ে সুজন শেখ বলেন, ‘দেশের অন্য যেকোনো মহাসড়কের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কগুলো দুর্ঘটনাপ্রবণ। কারণ এ মহাসড়কে রয়েছে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক বাঁক। রাতে চলাচলের সময় এসব বাঁকে বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন দেখা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবহনগুলো অতিরিক্ত গতিতে বাঁক অতিক্রমের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটির মতো অবৈধ গাড়ির চলাচল বেশি। এসব যানবাহনের কারণেও মহাসড়কটি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।’
সিলেট বিভাগের সঙ্গে সড়কপথে সারা দেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। প্রতিদিন এ পথ ধরে কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কের ৩৪ কিলোমিটার অংশ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, যেটি দিন দিন মহাবিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যাত্রীদের কাছে। প্রতি বছরই এ সড়কে ঝরছে অনেক প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে পড়েছে আশুগঞ্জ, সরাইল ও বিজয়নগর উপজেলা। ৩৪ কিলোমিটার এ পথে ঝুঁকিপুর্ণ বাঁক রয়েছে ৮-১০টি। এর মধ্যে আশুগঞ্জ গোলচত্বর, শাহবাজপুর তিতাস সেতুসংলগ্ন বাঁক, ভৈশামোড়া, রামপুরা, চান্দুরা, বীরপাশা ও ক্ষেতাবাড়ি এলাকার বাঁকগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পথ অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাতে এ মহাসড়কের বাঁকগুলোতে চালকরা নিয়ন্ত্রণ হারান বেশি।
দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু কার্যক্রম রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের। মহাসড়কের নিরাপত্তায় গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত এ ইউনিটের মুখপাত্র অতিরিক্ত ডিআইজি (এইচআর অ্যান্ড মিডিয়া) মো. শামসুল আলম বলেন, ‘১০ বছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে সারা দেশের মহাসড়কে ৮৮৩টি বিপজ্জনক বাঁক চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই বাঁকে বাঁকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। আশেপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়েও সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। পাশাপাশি মহাসড়কের চলাচলকারী চালকদের নিয়েও সভা হয়েছে।’ সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাঁকগুলোর দুর্ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা গেছে বলেও জানান পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
কেবল সচেতনতার মাধ্যমেই মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সচেতনতার পাশাপাশি মহাসড়ককে বাঁকমুক্ত করতেও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।