গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি :
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সকাল ৮টা থেকে করপোরেশনের ৫৭ ওয়ার্ডের ৪৮০ কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট শুরু হয়। বিরতিহীনভাবে চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ভোটগ্রহণ শুরুর আগে থেকেই কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছেন কিছু ভোটার। ভোট শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের মোটামুটি বড় লাইনই দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সকাল আটটায় ভোট শুরু হলেও তার অনেক আগেই কেন্দ্রে যান অনেক ভোটার। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা।
টঙ্গীর ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের দারুস সালাম মাদরাসা কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৭টার পর দেখা যায়, অনেক ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য তর সইছিল না তাদের। সেজন্য সাতসকালেই কেন্দ্রে হাজির হন তারা। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী ভোটারকেও বিভিন্ন কেন্দ্রে সকালে আসতে দেখা যায়।
গাজীপুর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ভোট কেন্দ্রে গিয়েও ভোটারদের সারি দেখা গেছে, এই কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগে পুরুষ ভোটারের পাশাপাশি অনেক নারীকে আসতে দেখা গেছে।
টঙ্গীর ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের দারুস সালাম মাদরাসা কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আজমত উল্লা বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে সকাল থেকে মানুষ ভোটকেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং একটি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন গাজীপুরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ভোটের যেকোনো ফলাফল অবশ্যই মেনে নেব।
জনগণ যে রায় দেবে তা মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি বলেন, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। সবসময় জনগণের মতামতের প্রতি আমি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আসছি। আজ জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে, আমি সেটা অবশ্যই মেনে নেব।
জয়ের ব্যাপারে নিজের আশাবাদের কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ, শিক্ষামূলক কাজ এবং যখন দুর্যোগ এসেছিল তখন আমি জনগণের পাশে ছিলাম। আমি যেখানে গিয়েছি জনগণ আমার সঙ্গে ছিল। জয়ের বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।
সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে জানিয়ে আজমত উল্লা বলেন, কেউ এজেন্ট দিতে না পারলে সেই দায়িত্ব তার।
৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। এসময় তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলমও ভোট দেন।
জায়েদা খাতুন বলেন, আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। আপনারা সবাই ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট দিন। ইভিএম নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ভোটকেন্দ্রগুলোর পরিবেশ এখন পর্যন্ত ভালো আছে। এসব নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।
আর মেয়রপ্রার্থী জায়েদা খাতুনের নির্বাচনী প্রধান সমন্বয়কারী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ৪৮০ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলছে। কিছু কেন্দ্রে এজেন্টদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তবে এতে কিছু যায় আসে না। মা, ছেলে ও গাজীপুরবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে আমার মা জায়েদা খাতুনকে ভোট দিতে। বিকাল ৪ টা পর্যন্তই যেন ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হয়। কোনভাবেই যেন সিসি ক্যামেরা ও ইভিএম মেশিন টেম্পারিং করা না হয়।
তিনি আরও বলেন, সরকার ও নির্বাচন সুষ্ঠু ভোটের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা শেষ পর্যন্ত দেখব, আমরা ভোটের মাঠে আছি। সর্বশেষ পর্যন্ত দেখব কোথাও কোন কারচুপি হয়েছে কী না! যদি সুষ্ঠু হয় তবে আমরা ভোটের ফলকে স্বাগত জানাব এবং ভালো ভোটের জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ দেব। আর কোন অনিয়ম হলে গাজীপুরবাসী তা মেনে নেবে না। এখন পর্যন্ত যে ভোট হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট।
ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার অনুরোধ করে জাহাঙ্গীর বলেন, আপনারা কেন্দ্রে এসে ভোট দেন। এই শহর আপনাদের, ভোটের মালিক আপনারা। কোন পেশি শক্তি যেন ভোট নষ্ট না করতে পারে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে কেউ বাঁধা দিয়ে ভোট নষ্ট করতে পারবে না। রাতে তারা এজেন্টদের তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের সকল এজেন্ট কেন্দ্রে গেছে, কিছু এজেন্টকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এজেন্ট তারপরও কেন্দ্রে ঢুকেছে। টঙ্গীতে কিছু জায়গায় এটা করেছে। আমরা আরও তথ্য নিচ্ছি।
ষাটোর্ধ্ব আব্দুল মালেক ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা নিয়ে জানান, সকাল ৮টায় ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করি। পরে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আমাকে ইভিএমে ভোট দেওয়ার নিয়ম বলেন। এরপর গোপন কক্ষে চলে যাই।প্রথমে ভোট দিতে না পেরে কয়েকবার বেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে।একপর্যায়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার গোপন কক্ষে যান, ভোট দেওয়া শিখিয়ে দেন। প্রথমবার ইভিএমে ভোট দিয়েছি। আমার ভালো লাগছে। তবে ভোট দিতে গিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিল।
৯৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা সখিনা বেগম নাতির কোলে চড়ে এলেন ভোটকেন্দ্রে। ভোট দিয়ে উচ্ছ্বসিত এই অশীতিপর। বললেন, ইভিএম ভালা। সহজে ভোট দিয়ে আইলাম।
বৃদ্ধার নাতি কাজল মিয়া বলেন, দাদি সকালে বললেন, আমি ভোট দেব আমাকে কেন্দ্র নিয়ে যাও। পরে ইভিএমে ভোট দিতে হবে বললে, তিনি বলেন কী জিনিস এটা, তারপর আমার মোবাইল ফোনো ভিডিও দেখাই। তারপর উনি ভিডিও দেখে সহজে ইভিএমে ভোট দিতে পেরেছেন।
এতো বয়স্ক মানুষকে ভোট দিতে কেন নিয়ে এসেছেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাদি সবসময় ভোট দেন। এবারও ভোট দিতে চেয়েছেন, তার আগ্রহের জন্যেই নিয়ে উনাকে এসেছি।
এই কেন্দ্রের প্রথম দিকে ভোট দিয়ে বেরিয়েছেন ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার জেসমিন আকতার।
তিনি বলেন, এবারসহ আমি মোট দুবার ভোট দিলাম। তবে ইভিএমে প্রথম ভোট দিলাম। ভালো লাগছে। কোনো ঝামেলা মনে হয়নি।
একই ওয়ার্ডের ভোটার মরজিনা খাতুন। তিনিও নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। বললেন, ইভিএমে ভোট দিলাম। ভোট দিয়ে ভালো লাগছে। পোলিং এজেন্টরা ভালো ছিলেন।
জানা গেছে, গাজীপুর সিটির মেয়র পদে আট, ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৪৬ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের ১৯ ওয়ার্ডে ৭৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মেয়র প্রার্থীরা হলেন- নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের মো. আজমত উল্লা খান, লাঙল প্রতীকে জাতীয় পার্টির এম এম নিয়াজ উদ্দিন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ এরশাদ, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন ও হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম।
এবার এই সিটিতে ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ ও পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী এবং ১৮ জন রয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার।
এ নির্বাচনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৩ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন থাকছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে রয়েছে-পুলিশ, র্যাপিড আ্যকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী।
গাজীপুর সিটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাব ও আনসার সদস্যদের ৩০টি টিমের পাশাপাশি ১৩ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া পুলিশের ১৯টি স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং ৫৭টি মোবাইল টিম রয়েছে।
এদিকে ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) বলে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৫৭টি ওয়ার্ডে ভ্রাম্যমাণ টিম থাকবে। এছাড়া ১৯ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১৯টি স্ট্রাইকিং ফোর্স ভোটকেন্দ্রে সজাগ থাকবে।