বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন

কাজ শেষ না করেই তুলে নিলেন ২০ কোটি টাকা

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
আপডেট : মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

কাজ শেষ না করেই ২০ কোটি টাকার বিল নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর যোগসাজশে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের অধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা-শিমরাইল ৮ লেন অংশের সাড়ে ৭ কিলোমিটার মেরামতের কাজে এ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। রিজেন্ট, জেকেজি ঘিরে শাহেদ ও ডা. সাবরিনাকে নিয়ে দেশব্যাপী যখন আলোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র তখন বেরিয়ে এলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি সড়কের মেরামত কাজের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের (এন-১) যাত্রাবাড়ী থেকে শিমরাইল পর্যন্ত সড়কটি ৮ লেনের। এরমধ্যে সড়কের কাজলা থেকে কাঁচপুর সেতুর পশ্চিমপাড়ের সংযোগ পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার। নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়কের এই অংশটি মেরামতের জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে দরপত্র আহ্বান করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকা জোন কার্যালয়। দরপত্রে অংশ নিয়ে মাসুদ হাই-টেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজটি পায়।

পরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০১৯ সালের ২০শে নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করার চুক্তি করে। চুক্তিপত্র নং-ডিজেড (ই-জিপি)/০৩-কন্ট্রাক্ট/পিএমপি (রোড) ২০১৯-২০২০ (টিআইডি-৩৫১৪৪৬)।

সড়কের কাজলা থেকে শিমরাইল পর্যন্ত ৭.৬ কিলোমিটার অংশে ওই কাজের চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৯৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা ৬৬ পয়সা। কাজের মধ্যে ছিল শিমরাইল মোড়ে সড়কের উভয় পার্শ্বে প্রায় ৪০০ মিটার সড়কের পাকা অংশ কেটে সেখানে বেস্ট টাইপ-২ (পাথর, খোয়া ও বালু মিশ্রিত আস্তরণ) এর কাজ করে তার উপরে রিজিড পেভমেন্ট (ঢালাই রাস্তা) করা, প্রকল্পের আওতাধীন সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেশিন দিয়ে কেটে সেখানে মেরামত, বিধ্বস্ত অংশ বেস্ট টাইপ-২ দ্বারা মেরামত করা, সড়কের গর্ত মেরামত করা, কাজলা থেকে চট্টগ্রামমুখী ৩ লেনে ওয়েরিং কোর্স করা এবং ১ লেন এসবিএসটি কাজ করা, ঢাকামুখী ৪ লেনে ডিবিএসটি (ডাবল বিটুমিনাস সারফেসিং ট্রিটমেন্ট) কাজ করা, সড়ক বাঁধ রক্ষা কাজ করা, সড়কের পার্শ্বে সসার ড্রেন নির্মাণ করা, সড়কে রোড মার্কিং, সাইন সিগন্যাল, ডিরেকশন সাইন, গাইড পোস্ট রং করা, সড়ক পার্শ্বের গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করাসহ আরো কিছু কাজ।

এই কাজের শুরু থেকে অনুসন্ধান এবং কাজের দরপত্র দলিল, অনুমোদিত প্রাক্কলন ও বিলের আইপিসি (ইন্টিরিয়াম পেমেন্ট সার্টিফিকেট) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিমরাইল মোড়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করার পূর্বে সেখানে ৫৫৩ কিউবিক মিটার বেস্ট টাইপ-২ এর কাজ পুরোপুরি করা হয়নি। কিছু অংশে সড়কের নিচের পুরনো আস্তরণ বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ সেখানে ১৬ লাখ ১৮ হাজার ৩৮ টাকা বিল দেয়া হয়েছে। মহাসড়কে ১৩৫ মিটার বিধ্বস্ত অংশ মেরামত করার জন্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৬ টাকা এবং ৮৯.২৫ কিউবিক মিটার গর্ত মেরামতের জন্য ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩৮ টাকা বিল দেয়া হয়েছে। অথচ মহাসড়কের এই অংশে এমন গর্ত ও বিধ্বস্ত অংশ থাকার চিত্র পাওয়া যায়নি।

সড়কের চট্টগ্রামমুখী অংশে এক লেন (৩.৬০ মিটার প্রস্তে) ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ২৫ হাজার ২০০ বর্গ মিটার এসবিএসটি সিঙ্গেল বিটুমিনাস সার্ফেসিং ট্রিটমেন্ট করার কথা। কিন্তু তা করা হয়নি। এ বাবদ বিল দেয়া হয়েছে ৫৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার বেশি। চট্টগ্রামমুখী বাকি তিন লেনে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ওয়েরিং কোর্স করার কথা থাকলেও কাজলা থেকে চট্টগ্রামের দিকে পৌনে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা করা হয়েছে। বাকি ১.২৫ কিলোমিটার করা হয়নি। অথচ এ খাতের পুরো বিল ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৭ টাকা দেয়া হয়েছে। ঢাকামুখী পুরো ৪ লেন (১০.৬০ মিটার প্রস্থে) ৭ কিলোমিটার এলাকায় ১ লাখ ২ হাজার ২০০ মিটার ডিবিএসটি (ডাবল বিটুমিনাস সারফেসিং ট্রিটমেন্ট) কাজ করার কথা।

সরজমিন দেখা গেছে, শিমরাইল থেকে ঢাকামুখী তিন লেন করা হয়েছে আড়াই কিলোমিটার এবং দুই লেন করা হয়েছে ২২০ মিটার দৈর্ঘ্যে। এতে দেখা যায়, ৪২ হাজার ৫০০ বর্গ মিটারের কিছু বেশি কাজ করা হয়েছে। আর এই কাজ বাকি রয়ে গেছে ৫৯ হাজার ৫০০ বর্গ মিটারের বেশি। অথচ ঠিকাদারকে এর পুরো বিল ৪ কোটি ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৪৮৮ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সড়কের পাশে সসার ড্রেন নির্মাণের জন্য ২৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৯ টাকা ও সড়ক বিভাজক নিউ জার্সি বেরিয়ার বাবদ ১৪ লাখ ১৩ হাজার ২৪৮ টাকা চুক্তিপত্রে থাকলেও কাজ হয়নি। কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়ে গেছে। সড়কে মার্কিংয়ের পুরো বিল ৯১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৯৭ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ সড়কের কোথাও এক ফোটা রংও দেয়া হয়নি। এছাড়া ৫টি ডিরেকশন সাইন স্থাপনের ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা, ৫০টি ট্রাফিক সাইন বসানো বাবদ ৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, ৫০টি সাইন পোস্টের জন্য ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং সড়ক পার্শ্বের ৩০০ গাইড পোস্ট রং করার জন্য ৭৪ হাজার ৯০০ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। অথচ এসবের একটিও এই প্রকল্পের আওতায় করা হয়নি।

সড়কের পাশে মাটি ভরাটের জন্য বিল দেয়া হয়েছে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকার বেশি। অথচ সড়কের পাশে কোথাও এক টুকরি মাটি ফেলা হয়েছে এমন চিত্র দেখা যায়নি। মহাসড়কের ৬ষ্ঠ কিলোমিটারে সড়ক বাঁধ রক্ষায় আরসিসি প্যালাসাইডিং নির্মাণে চুক্তি হয় ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার। সড়কের ওই অংশে কোনো প্যালাসাইডিংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। মোটকথা এতসব কাজ না করার পরও গত জুনের শেষ সপ্তাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত বিল দেয়া হয়েছে ১৯ কোটি ৯৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৪ টাকা। কাজের সমাপ্তি দেখানো হয়েছে ১০শে মে ২০২০ তারিখে। চূড়ান্ত বিলের আইপিসি (ইন্টিরিয়াম পেমেন্ট সার্টিফিকেট) করা হয়েছে ২৩শে জুন ২০২০ তারিখে। সোমবার সরজমিন শিমরাইল থেকে কাজলা পর্যন্ত মহাসড়কের ৭.৬ কিলোমিটার ঘুরে ওই সকল অসমাপ্ত কাজের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাকে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। আপনি একটু নির্বাহী প্রকৌশলীকে ফোন দেন।

পরে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রকল্পের কাজটা প্রায় শেষ। তবে কিছু কাজ বাকি আছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ বিভাগের আরো সংবাদ

আবহাওয়া

%d bloggers like this:
%d bloggers like this: