চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি :
আওয়ামী লীগ উঁকিঝুঁকি মারছে উল্লেখ করে সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
শনিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির উদ্যোগে র্যালি পূর্বে সমাবেশ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমাদের ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। আওয়ামী লীগ উঁকিঝুঁকি মারছে, ফ্যাসিস্টরা উঁকিঝুঁকি মারছে; এই ঐক্য ভাঙা যাবে না। তারেক রহমান যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তা অটুট থাকতে হবে। অটুট রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যেতে হবে, নির্বাচনের দিকে যেতে হবে, নির্বাচিত সরকারের দিকে যেতে হবে। যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তাদের আমরা সমর্থন দেব। তাদের আমরা শেষ পর্যন্ত সমর্থন দেব। আমরা এ সরকারকে আসা মাত্রই সমর্থন দিয়েছি। এখনো সমর্থন দিচ্ছি। আমরা চাই এ সরকার গণতন্ত্রের অধিকার ফিরিয়ে আনবে। তার জন্য আমরা সকলে মিলে কাজ করবো।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা পতনের গল্পের শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প শুনছি। ওরা এটা করেছে, ওটা করেছে। গত ১৫ বছর আমরা রাস্তায় আন্দোলন করেছি, জীবন দিয়েছি, গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছি, জেলে গিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, ব্যবসা হারাতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে। আমরা চাই শেখ হাসিনা বিদায় পরবর্তী দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরিয়ে আসুক।
তিনি বলেন, এখন যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা বিএনপি আরো ছয় বছর আগেই দিয়েছে। ৩১ দফা ঐ সংস্কার প্রস্তাবে সবকিছু আছে। সরকারের প্রতি অনুরোধ- যে কয়টি সংস্কার জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে করার সুযোগ আছে, তা সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে, শহিদ জিয়াকে মুক্ত করার মাধ্যমে এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ হলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাংলাদেশ, স্বাধীনতার বাংলাদেশ, আইনের শাসনের বাংলাদেশ, জীবনের নিরাপত্তার বাংলাদেশ, স্বাধীন-সার্বভৌম মাথা উঁচু করার বাংলাদেশ। সেই ধারা অব্যাহত রেখে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে স্বৈরাচারদের পতন ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারদের বিদায় করে আবারো শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়; সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছে। আবারো বাংলাদেশে মুক্তবাজার উন্মুক্ত হয়ে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে ফেলেছিল। যেই অর্থনীতির ভিত্তি জিয়াউর রহমান সৃষ্টি করেছিলেন; সেই অর্থনীতির ভিত্তিকে আরো শক্তিশালী করেছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
১/১১-এর প্রেক্ষাপট টেনে তিনি বলেন, ‘১/১১ পরবর্তী সময়ে কিছু লোক আবারও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ১/১১ পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, দেশের ভেতরে ষড়যন্ত্র, দেশের বাইরের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপিকে সেদিন তারা পরাজিত করেছিল। যে স্বৈরাচারকে ফের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। সেই শেখ হাসিনা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার তুলে নিয়ে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় জেলে দিয়ে, বিএনপির সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, নির্মম নির্যাতন, গুম, খুন করে সেদিন বাংলাদেশকে ফের জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীন করেছিল। সেদিন আবারও দেশনেত্রী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রুখে দাঁড়ানোর কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছে, তিনি জীবনের সঙ্গে লড়াই করেছেন, চিকিৎসা না দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর পরের আন্দোলন তারেক রহমান সাহেবের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল দেশের সমস্ত মানুষেকে উদ্বুদ্ধ করে, সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে মোটামুটি পরাস্ত করতে পেরেছিলাম। প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে আমরা সমাবেশ করেছিলাম, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের বিনিময়ে, সবকিছু উপেক্ষা করে তারা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় আমরা বিশ-ত্রিশ লাখ মানুষের সমাবেশ করেছিলাম। গুলি করে সেই সমাবেশ ভাঙতে চেয়েছিল, কিন্তু তারেক রহমানের নেতৃত্বের কারণে শেখ হাসিনার প্ল্যান সফল হয়নি। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা পরাস্ত করেছিল। সেই ধাক্কা খেয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে।’
শেখ হাসিনার পতনের পর এখন নতুন, নতুন গল্প শোনা যাচ্ছে- মন্তব্য করে বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা যদি পটভূমি তৈরি না করতাম, সেই অবস্থার সৃষ্টি না করতাম, তাহলে শেখ হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর কোনো সুযোগ ছিল না। এখন অনেক গল্প শুনছি। শেখ হাসিনার পতনের পর এখন গল্পের কোনো শেষ নেই, প্রতিদিন নতুন, নতুন গল্প শুনছি। অনেকেই বলছেন, ওরা না কি এটা করেছে, ওরা না কি সেটা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘১৫ বছর আমরা যখন রাস্তায়-রাস্তায় আন্দোলন করেছি, জীবন দিয়েছি, গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছি, গুমের শিকার হয়েছি, জেলে গিয়েছি বারবার, তখন তো আমাদের সঙ্গে কেউ আসেনি। আমাদের নেতাকর্মীদের ১৫ বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, ব্যবসা হারাতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হয়েছে, সারাদেশে কত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, কত নেতাকর্মী জেলখানায় চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে, কত নেতাকর্মী পুলিশের হেফাজতে মারা গেছে! আর তোমরা কয়জন?’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘হিসাব-কিতাব করলে কিন্তু অসুবিধা আছে। আমরা কিন্তু হিসাব-কিতাব করতে চাই না। আমরা বলছি, আমরা সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে বিদায় করে দিয়েছি। এখন আমরা সবাই মিলে দেশে যেন গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি। দেশবাসী তাদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, সংসদে যাবে, সরকারে যাবে, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে।’
‘জবাবদিহিতাহীন কোনো সরকার বাংলাদেশের কল্যাণ করতে পারে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি আবার পরিষ্কার করছি, জনপ্রতিনিধিত্বহীন কোনো সরকার জনগণের কথা বুঝবে না, জনগণের ভাষ্য বুঝবে না। কারণ, জনগণের কথা বুঝতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে, জনগণের দুঃখদুর্দশা বুঝতে হবে, দ্রব্যমূল্য কী সেটা বুঝতে হবে, জনগণ বিদ্যুতের বিল দিতে পারছে না সেটা বুঝতে হবে, মানুষ দু’বেলা খেতে পারছে না সেটা বুঝতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বয়ানে’ নির্বাচন না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমীর খসরু বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান, উনি একটা বয়ান দিয়ে কিছুদিন স্বৈরাচারী কায়দায় রাষ্ট্র চালিয়েছিলেন। সেই বয়ানে বলা হয়েছিল, দেশকে একদলীয়করণ না করলে দেশ না কি চলবে না। কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, শুধু একটি দল ছাড়া, কথা বলার স্বাধীনতা নেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বয়ান দিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। তাকে আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করে পরাজিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধের বয়ান দিয়ে খুন-গুম করে শেখ হাসিনা কিছুদিন চালিয়েছিল। সেটা আজকে নাই। জনগণের সমর্থন ছাড়া কিছু টিকে থাকে না।’
আমীর খসরু বলেন, ‘তারপর এখন শুনছি আরেক বয়ান। বাংলাদেশে কবে নির্বাচন হবে, সেটা এ বয়ানের মধ্যে নেই। বাংলাদেশের জনগণ কবে ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করবে, সেই বয়ান নেই। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হবে, সেই বয়ান নেই। এখন হচ্ছে সংস্কারের বয়ান। আরে সংস্কার কি আমাদের আগে আপনারা দিয়েছেন? ছয় বছর আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংস্কারের কথা বলেছেন। আমরা জনগণের কষ্ট বুঝেছি বলে দিয়েছি। তখন কারও মুখে সংস্কারের কথা শুনিনি। একবছর আগে তারেক রহমান সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। সেই প্রস্তাবে সবকিছু আছে, কিছু বাকি নেই, আপনারা যা বলছেন সেটাও আছে, সেটাই বাইরেও আছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু এটুকু বলি, যে কয়টি সংস্কার জাতীয় ঐক্যমতের পরিপ্রেক্ষিতে হবে, সেটুকু সংস্কার করে দিন। তারপর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান। যে সংস্কারে ঐক্যমত্য হবে না, সেটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে আগামীদিনে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ হবে তারা সিদ্ধান্ত নেবে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এর বাইরে অনির্বাচিত কারও কোনোকিছু করার অধিকার নেই। জাতীয় ঐক্যমতের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু সহসা হবে, সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জাতি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখতে চায়। তাদের নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়।’
সমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনীতি বদলে গেছে, ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকতে হবে। আগের রাজনীতি এখন নেই। যারা সুশৃঙ্খলভাবে রাজনীতি করতে পারবে তাদের ভবিষ্যৎ আছে। উচ্ছৃঙ্খল, চাঁদাবাজ, দখলদার, ভূমিদস্যুর জায়গা বিএনপিতে হবে না।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি হারুনুর রশীদ, ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর প্রমুখ।